ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তীরন্দাজ রিতুর ব্যতিক্রমী পথচলা!

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২৩ মে ২০১৮

তীরন্দাজ রিতুর ব্যতিক্রমী পথচলা!

মানুষ ওপরে ওঠে ধাপে ধাপে। উন্নতি করে ধীরে ধীরে। ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হয়। কিন্তু ধরুন, যদি এর বিপরীতটাই ঘটে, তাহলে কেমন হবে? এমন অবাক কা-ই ঘটিয়েছে সপ্তদর্শী এক সুদর্শনা। নামটি তার রিতু আক্তার। কিভাবে কি ঘটাল, সেটাই আগে জেনে নেয়া যাক। গত ৯ মে। ঢাকায় মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামে শেষ হয় আইএসএফ ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ। এই আসরে অংশ নেয় স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ১৬ দেশ। সর্বাধিক ৫ স্বর্ণ জিতে তারা গত আসরের মতো এবারও চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশের এই ৫ সোনার একটি হচ্ছে এই রিতুর। কম্পাউন্ড মহিলা দলগত ইভেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশ ২১৬-১৫২ স্কোরের ব্যবধানে হারায় মরক্কোকে। তিনজনের দলে রিতুর বাকি দুই সঙ্গী রোকসানা আক্তার এবং বন্যা আক্তার। তারা পরাভূত করেন এল আসাদি কাদিয়া, ফাইজ সৌদ ও কারদাউদ ফাতিমা জাহরাকে। ২২ মে, ২০০১ সালে জন্ম রিতুর। তার মানে আর ক’দিন পরেই জন্মদিন। ৯ মে সোন জিতে জন্মদিনের আগেই যে সে সবচেয়ে বড় উপহারটা সে পেয়ে গেছে, এ নিয়ে অসম্ভব উচ্ছ্বসিত সে, ‘আমার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক এটা। এজন্য কি যে আনন্দ লাগছে, তা বলে ঠিক বোঝাতে পারব না। এক কথায় আমি খুবই রোমাঞ্চিত। এটাই আমার জন্মদিনের অগ্রিম এবং বড় উপহার!’ রিতু অনেকটাই ব্যতিক্রম। অন্য আরচাররা যেমন ক্লাব পর্যায়ে, জাতীয় পর্যায়ে এবং সবশেষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক জিতে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়, সেখানে রিতুর বেলায় ঘটেছে পুরো উল্টো ঘটনা! জীবনের প্রথম পদকটি সে জিতেছে আন্তর্জাতিক আসরে! যদিও এটা রিতুর আন্তর্জাতিক আরচারির আসরে প্রথমবারের মতো অংশ নেয়া নয়। এর আগে সে সাউথ এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিল, গত এপ্রিলে, সাভারের জিরানির বিকেএসপিতে। সেই আসরে কম্পাউন্ড ইভেন্টে রিতু অংশ নিয়ে কোন পদক জিততে পারেনি। এ প্রসঙ্গে তার স্মৃতিচারণ, ‘ওখানে এ-টিম, বি-টিম নামে খেলা হয়েছিল। আমি খেলেছিলাম বি-টিমের হয়ে। অন্য সবাই পদক জিতলেও আমি কিছু পাইনি। এজন্য তখন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই কষ্ট দূর হয়েছে ঢাকায় স্বর্ণপদক জিতে। খুব ভাল লেগেছে। যদিও এটা দলীয় স্বর্ণপদক, তারপরও আমার কাছে এর মূল্য অনেক।’ স্বর্ণ জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ^াসের মাত্রাটা কোন্ পর্যায়ে ছিল? ‘নিজের প্রতি এবার অনেক আত্মবিশ^াস ছিল। তার কারণ আমার অনুশীলন ও প্রস্তুতি খুবই ভাল হয়েছিল।’ যদিও এই আসরে আরেকটি পদক জেতার সম্ভাবনা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত সেটা জিততে পারেনি রিতু। মাত্র ২ পয়েন্টের ব্যবধানে সে হেরে যায় স্বদেশী বন্যা আক্তারের কাছে, কম্পাউন্ড এককে। বন্যা তাম্রপদক জেতে। ‘ব্রোঞ্জ জিততে না পেরে খুব খারাপ লেগেছিল। আমার হারার কথা ছিল না। তবে দলগত স্বর্ণ জিতে সেই দুঃখ ভুলে গেছি।’ ঝলমলে দেখালো রিতুর মুখটা। তীরন্দাজ সংসদের তীরন্দাজ রিতু। বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপলের ক্লাব এটি। রিতুরা তিন ভাই-বোন। রিতু মেজো। বড় বোন সায়মা আক্তার সেতু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরচার। ছোট ভাই সামিউল বিশ^াস রবিউল বিকেএসপির বক্সার। পাঠক ঠিক ধরেছেনÑ বড় বোনকে দেখেই আরচার হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগে রিতুর হৃদয়ে। এভাবেই তীর-ধনুকের এই খেলাটিতে জড়িয়ে পড়ে সে। সায়মা জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যাম্বো ইভেন্টে পদক জিতেছিল, এখন অবশ্য বেছে নিয়েছে রিকার্ভ ইভেন্ট। অবশ্য আরেকটা কারণে আরচারি খেলার প্রতি আকৃষ্ট হয় রিতু। শোনা যাক তার জবানীতেই, ‘আসলে ফরিদপুরে আমাদের বাড়ির আশপাশেই ছিল আরচারি খেলার আদর্শ পরিবেশ। পাড়ার বড় ভাই-বোনরা মাঠে গিয়ে আরচারি খেলত। আমার বোনও তাই। তাদের দেখেই খেলাটির প্রতি আগ্রহ জন্মে। তাছাড়া ওখানে চুন্নু স্যারের একটি আরচারি ক্লাবও ছিল।’ ২০১৬ সাল থেকে আরচারি খেলা শুরু করে রিতু। তখন সে পড়ে দশম শ্রেণীতে। তৃণমূল পর্যায়ের আরচার হিসেবেই পথচলা শুরু। প্রথমে অবশ্য রিকার্ভ ইভেন্ট দিয়ে শুরু করলেও পরে বদলে নেয় কম্পাউন্ড ইভেন্ট। বিস্ময়কর ব্যাপারÑ এর আগে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তেমন আশাব্যঞ্জক রেজাল্ট করেনি রিতু! ‘রিকার্ভে কখনই আন্তর্জাতিক কোন আসরে অংশ নিইনি। তবে ন্যাশনাল ক্যাম্পে ছিলাম জুনিয়র আরচার হিসেবে।’ রিকার্ভ থেকে কম্পাউন্ডে কেন সরে আসা? নিজের ইচ্ছাতেই? ‘না, ঠিক তা নয়। আমি নিজের ইচ্ছাতে ইভেন্ট বদলাইনি। ক্লাবের ক্যাম্প থেকেই স্যাররা এটা বদলে দেন। তারা হয়ত মনে করেছেন রিকার্ভের চেয়ে কম্পাউন্ডেই আমি বেশি ভাল করব। আমিও কোন আপত্তি করিনি এ ব্যাপারে, মেনে নিয়েছি।’ তীরন্দাজ ক্লাব থেকে কিভাবে জাতীয় দলে আসা হলো, সেই গল্পটাও শোনায় রিতু, ‘ক্লাব থেকে বাছাই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আমি তাতে অংশ নিই এবং ভাল রেজাল্ট করি। এভাবে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়ে যাই।’ ডাক পেয়ে রিতু যে কাউকে হতাশ করেননি, স্বর্ণপদক জেতাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ‘এই গোল্ড মেডেল জয় আমাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আরও উৎসাহ জোগাবে।’ ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার আলীপুর খাপাড়া গ্রামের মেয়ে রিতু। পড়াশোনা করছে ফরিদপুর সিটি কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষে, মানবিক বিষয় নিয়ে। কলেজের সহপাঠীরা কি রিতুর আরচার পরিচয়টা জানে? জানলে কতটা? ‘তারা জানে আমি কিছু একটা খেলি। কিন্তু আরচারি যে আসলে কি, সেটা তারা বোঝে না। মানে এই খেলা সম্পর্কে ভালভাবে ধারণা না থাকলে যা হয় আর কি! তবে আমার স্কুলের ফ্রেন্ডরা আবার খেলাটা সম্পর্কে ভালই জানত।’ বাবা আতিয়ার বিশ^াস। সাবেক ব্যবসায়ী। মা চম্পা বেগম, গৃহবধূ। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রিতু। স্বর্ণপদক জেতার খবরটি নিজের আরচার বড় বোনকে সবার আগে জানিয়েছে রিতু। ‘ফাইনালের আগের রাতেই আপুকে ফোনে জানিয়েছিলাম। আপু আমার জন্য অনেক দোয়া চেয়েছে। উপদেশও দিয়েছে। অনেক টেনশনও করেছে। স্বর্ণ জেতার পর বলেছে, আমি তো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদকই পাইনি, এজন্য আফসোস ছিল। আর তুই তো একেবারে স্বর্ণ জিতে দেখিয়ে দিলি! আপু আমার এই সাফল্যে অনেক খুশি হয়েছে। পরে মা-বাবাও জেনেছে। তারাও ভীষণ আনন্দিত।’ ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘এসএ গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে সবগুলোতেই পদক জিততে চাই। এছাড়া যতদিন ফর্ম-ফিটনসে থাকবে, ততদিনই আরচারি খেলতে চাই।’ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখাল রিতুর চেহারাটা। ‘এজন্য যত কঠিন পরিশ্রম ও অনুশীলন করতে হয়, তার সবই করব’। যোগ করে সে। এছাড়া আগামীতে কোন প্রতিরক্ষা সংস্থায় চাকরি করার পাশাপাশি আরচারি খেলাটা চালিয়ে যাওয়ারও স্বপ্ন দেখে সে। ইসলামি সলিডারিটি আন্তর্জাতিক আরচারি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগে দু’মাস সময় পেয়েছিল রিতু অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে শাণিত করে নিতে। অবসরে গান শুনে ও বই পড়ে থাকে রিতু। আদর্শ আরচার? ‘রোমান সানা ভাইয়ের খেলা খুব ভাললাগে। যদিও তিনি আমার ইভেন্টের আরচার নন, তারপরও তার খেলার প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা আমার অনেক ভাললাগে। তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। উনি আমাকে মাঝে মাঝে উপদেশও দেন। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি উপদেশ দেন আরচার শান্ত ভাইয়া, ওনার বাড়ি ফরিদপুরে আমাদের বাড়ির পাশেই।’ এখন দেখার বিষয়- আগামী দিনগুলোতেও আরচারিতে এ রকম নজরকড়া সাফল্য কুড়াতে পারে কি-না তীরন্দাজ রিতু আক্তার।
×