ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নানা সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে কৃষিপণ্যের রফতানি

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২২ মে ২০১৮

নানা সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে কৃষিপণ্যের রফতানি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সম্ভাবনাময় হওয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্যের রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নানা সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এ খাতের রফতানি। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ায় আলু রফতানি বন্ধ আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পান রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞাও উঠছে না। এছাড়া দিন দিন সবজি রফতানিও কমছে। রফতানিকারকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিপণ্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি না থাকা, মানসম্মত বীজের অভাবসহ নানা কারণে কৃষিপণ্যের রফতানি সেভাবে বাড়ছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) একজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জানান, বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ট প্রটেকশন কনভেনশন (আইপিপিসি) সনদ অনুসমর্থনকারী দেশ। এজন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের জন্য ডব্লিউটিও ও আইপিপিসির বিধি-বিধান মেনে চলা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে বরই বাদে সব শাক-সবজি ও ফলমূল রফতানির জন্য উন্মুক্ত। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কৃষিপণ্য রফতানি হয় ৩৫২ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমান অর্থবছরে একই সময়ে হয়েছে ৪০৬ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে শাক-সবজি রফতানি একই সময়ে ৫০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ৪৯ দশমিক ০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রফতানি শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আলু রফতানি হয়েছিল মাত্র ১৮ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ১৪ হাজার ১৫৭ টন। কিন্তু আমাদের দেশে আলু উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে কৃষকরা আলুর ন্যায্যমূল্য পান না। আলু রফতানির বাড়ানো হলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন না। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে কাঁঠাল রফতানি হয়েছিল ৯৯২ দশমিক ৮২ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর রফতানির পরিমাণ কমবে। কিন্তু একটু চেষ্টা করলে কাঁঠাল রফতানি বাড়ানো যায়। ফ্রুটস এ্যান্ড ভেজিটেবল এ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে কৃষিপণ্য রফতানির জন্য এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি খুবই জরুরী। কিছু কোয়ারেন্টাইন টেস্ট আছে, সেগুলো আমাদের এখানে ঠিকভাবে হয় না। ল্যাব থাকলে কৃষিপণ্যের রফতানি আমরা এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে পারব খুব সহজেই। এখন রফতানি ৫০০ মিলিয়নের ঘরও অতিক্রম করে না।’ ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পান রফতানি বন্ধ আছে জানিয়ে মনজুরুল ইসলাম বলেন, পান রফতানির ক্ষেত্রে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া উপস্থিত অন্তরায়। ইইউর রিকোয়্যারমেন্ট হচ্ছে, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে স্যালমোনেলামুক্ত পান সরবরাহ করা। আমরা কিছু স্থান সিলেক্ট করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের (কৃষকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক মানসম্মত পণ্য উৎপাদন) মাধ্যমে পান উৎপাদন করছি। আমরা তিনটি ল্যাবরেটরিতে পান পরীক্ষা করে স্যালমোনেলামুক্ত পান পেয়েছি। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, এ্যাক্রেডিয়েটেড ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে পণ্য দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে স্যালমোনেলা টেস্টের জন্য এখনও এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাব সেভাবে হয়নি। তারপরও এ বিষয়ে আমরা সরকারকে ইইউর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাব না থাকলেও আমরা মনে করি স্যালমোনেলামুক্ত পান আমরা দিতে পারব। তিনি আরও বলেন, সবাই মিলে কাজ করে পান রফতানির সমস্যাগুলো নিরসন করতে পারলে প্রতি বছর ১০০ থেকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হতে পারে শুধু এই পান থেকে। পান রফতানির বড় অংশই যেত ইউরোপে তাই কয়েক বছর ধরে পান রফতানি বলতে গেলে থমকে গেছে। বাংলাদেশ পটেটো এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ আব্দুল কাদের বলেন, আলু রফতানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে উপযোগী জাতের অভাব। সারা বিশ্ব অনেক এগিয়ে গেছে। আলু উৎপাদনে আমরা যদিও সপ্তম অবস্থানে আছি। এর উৎপাদন প্রতি বছরই বাড়ছে। কিন্তু রফতানি উপযোগী জাতের অভাব রয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগে গ্রানুলা জাতের আলু রফতানি হতো, এখন এ জাতের আলু বিভিন্ন দেশ আর নেয় না। কারণ অন্যান্য দেশ ভাল জাত দিচ্ছে। আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পাওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে আলু নিচ্ছে না। রাশিয়ায় আলু রফতানির নিষেধাজ্ঞা এখনও ওঠেনি জানিয়ে আব্দুল কাদের বলেন, সরকার যদিও এ বিষয়ে চেষ্টা করছে। রাশিয়া হচ্ছে আলুর সবচেয়ে বড় গন্তব্য। ইন্দোনেশিয়ায় আমাদের আলু রফতানি বন্ধ আছে। এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরিতে আমাদের সবকিছু আটকে আছে। এ বিষয়ে আমাদের এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি করা খবুই জরুরী। শেখ আব্দুল কাদের বলেন আমাদের আলু উৎপাদন এক কোটি টনের বেশি, প্রতি বছরই আলুর উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু আমাদের রফতানি একেবারেই কম। আমাদের থেকে আড়াই গুণ কম আলু উৎপাদন করেও পাকিস্তান আলু রফতানিতে বিশ্বে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু আমাদের কোন অবস্থান নেই। রফতানিকারক, সরকারসহ এ বিষয়ে সবার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। সমস্যা রয়েছে কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছে না। কৃষিপণ্যের রফতানির বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ইকবাল রউফ মামুন বলেন, কৃষিপণ্যে মাইক্রোবিয়াল কন্টামিনেশন (দূষণকারী জীবাণু) বেশি। এছাড়া ফাইটোস্যানিটারি রিকোয়ারমেন্টের (পণ্যে স্বাস্থ্যহানিকর কিছু নেই তা নিশ্চিত করা) কোন ল্যাকিংস (অভাব) থাকে তাহলে তারা তো নেবে না। কিন্তু এগুলো আমাদের এখানে সঠিকভাবে না হওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমাদের এই বাধাগুলো দূর করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে সেই রকমভাবে এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরিও নেই। এজন্য ল্যাবরেটরি, দক্ষ জনশক্তি, লজিস্টিক সাপোর্টÑ এগুলো আগে করতে হবে। এগুলো না করলে বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক তথ্যটা পাব না। সঠিক তথ্য না পেলে দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা পণ্য প্রস্তুত করতে পারব না। দেশে এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি ভীষণভাবে প্রয়োজন। ফাইটোস্যানিটারি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরিতে জনবলের সঙ্কট রয়েছে। কিছুদিন আগে দুজন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন। ফলে জনবলের সঙ্কট আরও প্রকট হয়েছে। এ অবস্থায় ল্যাবরেটরি এ্যাক্রিডিটেশন করা দুরূহ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসীন বলেন, কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে নানা ধরনের সংস্কারমূলক কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। এর আওতায় পিসি জালিয়াতি রোধে নিরাপত্তা হলোগ্রামযুক্ত পিসি (ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট) ছাপানো, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে স্ক্যানার মেশিন বসানো, সটিং, গ্রেডিং, ট্রিটমেন্ট কুলিং প্যাকিং সুবিধাসহ ঢাকার শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আমরা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি চালু, কৃষকদের সঙ্গে নির্ধারিত ফরমে চুক্তি সম্পন্ন করা, শাক-সবজি ও আম উৎপাদনে গাইডলাইন প্রণয়ন করেছি। কিছুদিনের মধ্যে আম রফতানি শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, শাক-সবজিটা একটু কম (রফতানি) হচ্ছে, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানি করতে পারছি না। তারা মানের সঙ্গে আপস করে না। তাদের অনেক রিকোয়ারমেন্ট আছে, সেগুলো ফুলফিল করলে আমরা রফতানি করতে পারব। কোন কোন ব্যবসায়ী মান নিয়ন্ত্রণ না করে সরাসরি কৃষিপণ্য রফতানি করে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছেন জানিয়ে ডিএইর মহাপরিচালক বলেন, এজন্য আমরা কিছু ক্ষেত্রে রফতানি বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা চাই দেশের সুনাম যাতে ক্ষুণœ না হয়। রফতানি করা পণ্য যাতে ফেরত না আসে। ইউরোপের বাজার ধরাটা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, রাশিয়ায় আলু রফতানির ব্যাপারে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের একটি টিমও যাবে রাশিয়ায়। এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি ছাড়া আমরা সব রিকোয়ারমেন্টই ফুলফিল করেছি। মহাপরিচালক আরও বলেন, এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবের বিষয়ে আমরা মিটিং করেছি, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে বলা হয়েছে, তাদের তো বিজ্ঞানী আছে। এ্যাক্রেডিটেশন নিতে হলে এ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডে আবেদন করতে হয়, তারা এসে আমাদের সক্ষমতা দেখবে। দক্ষ জনবল আছে কিনা, একটু সময় লাগে। আমরা প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ফাইটোস্যানিটারি-সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ প্রকল্প থেকে কেনা যন্ত্রপাতির তালিকা, যন্ত্রপাতির বর্তমান প্রকৃত অবস্থা, কখন কেনা হয়েছে এবং কী উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছে, কয়টি সচল রয়েছে এবং কয়টি অচল রয়েছে, সচল না থাকার কারণ এবং ল্যাবরেটরির যন্ত্রগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের বাস্তবচিত্র ইত্যাদি বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য যুগ্ম সচিবের (সম্প্রসারণ) নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই কমিটি নিরাপদ (আন্তর্জাতিক মানের) কৃষি পণ্য আমদানি ও রফতানির জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি স্থাপনসিহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি ছাড়া রাশিয়ায় আলু রফতানি দুরূহ হবে। তবে এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ইন্দোনেশিয়া আলু রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হতে পারে। দেশটিতে আলুসহ ফ্রেস ফুড অব প্ল্যান্ট অরিজিন (এফএফপিও) রফতানির ক্ষেত্রে সরকারি ফুড সেফটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় আলু রফতানির জন্য তাদের নির্ধারিত ফরমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ফরমটি পূরণের জন্য বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডে পাঠানো হয়েছে। পূরণ হলে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে তা উপস্থাপন করা হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া যাতে শনাক্ত করা যায় এবং পানসহ সব কৃষিপণ্য রফতানির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরি যাতে প্রয়োজনীয় জনবলসহ স্থাপন করা যায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তাকে নিয়ে যুগ্ম সচিবের (সম্প্রসারণ) নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
×