ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২২ মে ২০১৮

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

(গতকালের পর) বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রাথমিক সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে গাছ কেটে ফেলা, মোবাইল ফোনের বহুল ব্যবহার, জলাভূমি ভরাট করা, নদী শুকিয়ে যাওয়া, কলকারখানা ও মোটরগাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মোবাইল ফোন ও বৈদ্যুতিক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি কাজে ভারী যন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি। এ ছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্দ্র ও উষ্ণ বায়ু বঙ্গোপসাগর হতে উত্তরে অর্থ্যাৎ দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রায় একই সময়ে শুষ্ক ও ঠা-া বায়ু হিমালয় থেকে দক্ষিণে অর্থ্যাৎ দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব কারণে দেশের অভ্যন্তরে বজ্রসহ কালবৈশাখী ঝড় সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করছে। আমরা পরিবেশের প্রতি যতœবান হলে নিশ্চয়ই পরিবেশ আমাদের সঙ্গে এমন বিরূপ আচরণ করত না। বস্তুত প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রকৃতির উপকরণ ইত্যাদি আল্লাহতায়ালার কুদরতের নিদর্শন। পৃথিবীতে কোনো কিছু অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। সবকিছু মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টির কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। দুনিয়ায় সবকিছু পরিমিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জন্য অপূর্ব নিয়ামত। এই পরিবেশ ধ্বংস ও বিনষ্ট করার কারনে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রকৃতির সব উপাদান ও সম্পদ, বন-জঙ্গল, নদীনালা ও খালবিল, মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বত এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে- যা কিনা প্রকৃতিতে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির জন্য এরূপ সুষম ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা প্রয়োজনীয়। গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে অসংখ্য প্রাণহানি ও গবাদিপশুর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এনিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বজ্রপাত যেহেতু সাধারণত উঁচু কোন কিছুতে আঘাত করে, সে জন্য উঁচু গাছ হিসেবে সহজলভ্য তালগাছকেই বেছে নেয়া হয়েছে বজ্রপাত ঠেকানোর স্থানীয় প্রযুক্তি হিসেবে। বজ্রপাতের ঝুঁকি প্রশমনে দেশের ৬৪টি জেলায় তালগাছ লাগানোর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে। গবেষকদের মতে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানোর জন্য এটাই সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় প্রযুক্তি। থাইল্যান্ডেও স্থানীয় প্রযুক্তি হিসেবে তাল গাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। দেশের বিশেষজ্ঞরা ও মনে করেন বজ্রপাত যেহেতু উঁচু জায়গায় আঘাত করে, সে হিসেবে তালগাছ মৃত্যু কমাতে সহায়ক হবে। কিন্তু বজ্রপাতে আঘাত পাওয়া গাছটি নষ্ট হয়ে যাবে। পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে ভিয়েতনামে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ব্যবহৃত প্রযুক্তিবান্ধব টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। হাওড় এলাকায় টাওয়ার নির্মাণ করা হলে স্থায়ী ব্যবস্থা হতো বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কালবৈশাখী ঝড়ের সময় দেশের কোথায় বজ্রপাত হতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে আবহাওয়া অফিস। এমনকি ১০ মিনিট থেকে আধাঘণ্টা আগে বজ্রপাতের সঙ্কেত দেয়া যাবে। এতে ওই এলাকার মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার সময় পাবে। ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমে আসবে দেশে। বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত জানতে ইতোমধ্যে দেশের আটটি স্থানে বসানো হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর। স্থানগুলো হচ্ছে বরিশালের পটুয়াখালী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, নওগাঁর বদলগাছি, ময়মনসিংহ, সিলেট ও খুলনার কয়রা। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তাদের মতে আটটি সেন্সরে পুরো দেশের চিত্র উঠে আসবে। একেকটি সেন্সরের রেঞ্জ ২৫০ কিলোমিটার। প্রতিটি সেন্সর থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত মনিটরিং করা যাবে। এক মৌসুমে (এপ্রিল থেকে জুন) দেশে কতবার বিদ্যুত চমকায় এবং বজ্রপাত হয় সেটির রেকর্ড ও থাকবে এই সেন্সরে। ডিটেকটিভ সেন্সরের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এলাকার নামও জানা যাবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চলতি বছরের শেষ নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হবে। আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৩টি নদীবন্দরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাতের সঙ্কেত ও সংখ্যা নিরূপণের যন্ত্রপাতি ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয় করা হয়েছে। বজ্রপাতে প্রাণহানির বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রেখে এর ঝুঁকি হ্রাসের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাধারণ মানুষের সচেতনতা। সঙ্কেত পাওয়ার পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে, তাহলে এসব উদ্যোগ সুফল বয়ে আনবে। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, জাপান, কানাডা, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বলেই বাংলাদেশকে বজ্রপাত প্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চৈত্র-বৈশাখে কালবেশাখীর সময়ে বজ্রপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জাতীয় পরিকল্পনায় মোট ১২টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উল্লেখ থাকলেও প্রাণঘাতী বজ্রপাতের কথা উল্লেখ ছিল না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাতের ভয়াবহতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে গত ১৭ মে ২০১৬ তারিখে প্রাকৃতিক এই আপদটিকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে করণীয় নির্ধারণে উদ্যোগী হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনায় এক হাজার আট শ’র বেশি মানুষ মারা যায়। দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে, গত ৮ বছরে সারাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি। বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হাওর অঞ্চলের নয়টি জেলায়। বজ্রপাতে গবাদিপশুরও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ২০১১ সালে হাওড় জেলা সুনামগঞ্জের স্বরসতীপুর গ্রামের একটি মসজিদে সন্ধ্যায় নামাজের সময় বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়, বৈদ্যুতিক পাম্প নষ্ট হয়ে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়, ভারি বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, বজ্রঝড়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়, ফসলের ক্ষতি হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সব থেকে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস এ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবেলিটি’ শীর্ষক গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়। গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেন- বজ্রপাতে বছরে মাত্র দেড় শ’র মতো লোকের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলেও আসলে এ সংখ্যা ৫০০ থেকে এক হাজার। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×