ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জমজমাট দর্জির দোকান, চুটিয়ে অর্ডার নিচ্ছে ॥ ‘ঈদ কালেকশন’ দেখতে মার্কেটে মার্কেটে চলছে ঘোরাঘুরি

ঈদের পাইকারি বাজার জমে উঠলেও প্রভাব নেই খুচরায়

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২২ মে ২০১৮

ঈদের পাইকারি বাজার জমে উঠলেও প্রভাব নেই খুচরায়

রহিম শেখ ॥ একদিকে ঈদ বাজার, অন্যদিকে ইফতার বাজার। দুটোর কদরই রমজানে। তবে গত বছরের তুলনায় অনেকাংশেই বেড়েছে ইফতার বাজারের খরচ। মূলত কাঁচাবাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তেজিভাবে এবার চড়া দাম ইফতারি পণ্যের। এদিকে ঈদের কেনাকাটা খুচরা বাজারে না জমলেও পাইকারি বাজার এখন বেশ জমজমাট। শব-ই-বরাতের পর থেকে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের আনাগোনা বেড়েছে নগরীতে। তবে খুচরা বাজারের ব্যবসায়ীরা ‘বৃষ্টি’ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, অতিমাত্রার বৃষ্টি হলে ঈদের কেনাকাটায় ভাটা পড়বে। অবশ্য বৃষ্টি নিয়ে তেমনটা ভাবছেন না রাজধানীর দর্জি দোকানিরা। তারা দেদার অর্ডার নিচ্ছেন, চলবে রমজানের শেষ অবধি পর্যন্ত। এদিকে বাড়তি আয়ের আশায় নিম্ন আয়ের মানুষগুলোও ছুটছেন নগরীতে। মূলত রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর সামনে রেখে হকার, ছোট ব্যবসায়ী, রিক্সাচালক ও আবার কেউ ভিক্ষুকের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। সব শ্রেণী পেশার মানুষের মুনাফা বৃদ্ধির এই চেষ্টাই জানান দিচ্ছে উৎসবের আগমনী বার্তা। আর এই উৎসব রঙ্গিন করতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ যোগ হচ্ছে অর্থনীতিতে। উৎসবের বর্ণিল মাত্রা যোগ করতে বাজারে আসছে নতুন টাকা। এখন চলছে টাকা ছাপানোর কাজ। রমজানের মাঝামাঝিতে ব্যাংকগুলোতে নতুন চকচকে নোট সরবরাহ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, বিপণি বিতান, ফ্যাশন হাউস ও শপিংমল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিবারের ন্যায় এবারও রোজা আসার আগে থেকেই ঈদ কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। তাই ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। দোকানে দোকানে নতুন পোশাক সাজাতে ব্যস্ত কর্মীরা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, নামকরা ব্র্যান্ড কিংবা ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের নামে এবারও জায়গা দখল করছে ঈদের নতুন পোশাক। কেউ আত্মীয়-স্বজনদের উপহারের জন্য কেনাকাটা করছেন। কেউবা গ্রামে কিংবা বিদেশে দেশী পোশাক পাঠানোর জন্য আগেভাগে পোশাক কিনছেন। আবার অনেকেই নগরীর বিপণি বিতান বা দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়ান- এবার ঈদে নতুন পোশাক বা জামা-কাপড় কী এলো তা দেখতে। বিশেষ করে তরুণী বা ধনিক শ্রেণীর গৃহিণীদের বেলায়ই এ রকম প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কিন্তু এবার অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা আগেভাগেই ঈদের কেনাকাটা সারছেন। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে এবারও কদর বাড়ছে দেশী পোশাকের। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার আমদানি করা পোশাক ও জুতার পরিবর্তে দেশী ব্র্যান্ডের চাহিদা বাড়বে। দেশী ফ্যাশন হাউজগুলোতে ঈদের নতুন পোশাক উঠতে শুরু করেছে। রাজধানীর চাঁদনী চক মার্কেটের নিউইয়র্ক কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নওশাদ আহমেদ বলেন, ক্রেতারা বেশ আগে থেকেই কেনাকাটা শুরু করেছেন এটা ঠিক, কিন্তু বেশিরভাগই ঘুরে ঘুরে ঈদ কালেকশন দেখছেন। মূল বাজার শুরু হবে রোজার প্রথম সপ্তাহ থেকে। তবে এখন যেমন শুরু হয়েছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবার ব্যবসা ভাল হবে বলে আশা করা যায়। শব-ই-বরাতের পর থেকেই রাজধানীর দর্জির দোকানগুলো বেশ সরব হয়ে উঠেছে। সময়মত কাজ বুঝে দিতে রাতভোর কাজ করছেন দর্জি কারিগররা। ১৫ রমজানের পর কোন অর্ডার বুকিং নেয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন দর্জি দোকানিরা। স্কুলশিক্ষিকা ফেরদৌসী খাতুন বলেন, রমজানের মাঝামাঝিতে মানুষের এত ভিড় হয় যে পা ফেলার জায়গা থাকে না, তাই একটু তাড়াতাড়িই এসেছি। আবার কিছুদিন পর থেকে টেইলার্সে পোশাক তৈরির অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দেবে, তাই তাড়াতাড়ি কিনে ওইগুলো বানিয়ে নিতে চাই। দুই বান্ধবীকে নিয়ে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা ইসলাম চাঁদনী চকে এসেছেন ঈদের পোশাক কিনতে। এত আগেই কেন ঈদের বাজারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকদিন পরেই ক্লাস বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামের বাড়ি চলে যাব। তাই একটু আগেই ঈদের শপিং করতে এসেছি। ঈদ উপলক্ষে বাড়তি আয়, বাড়তি লাভের আশায় কাজের সন্ধানে অনেকেই এখন নগরমুখী। এদের অধিকাংশই খেটে খাওয়া শ্রমিক। রাজধানীতে এরা এক মাসের অতিথি। ঈদের দু’একদিন আগে বা পরে এসব অতিথি আবার পাড়ি দেবেন আপন নিবাসে। ঢাকায় এসে তারা দোকানের কর্মচারী, হকার, রিক্সা চালানো ও কেউ কেউ ভিক্ষুকের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। ঢাকায় আসছেন ছোটখাটো খুচরা ব্যবসায়ীরাও। নগরীর প্রতিটি পাইকারি মার্কেটে প্রতিদিনই ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়ছে। কেরানীগঞ্জ, ইসলামপুরসহ ঢাকার বড় বড় পাইকারি মার্কেট এখন কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে। এসব কারণে ঢাকায় প্রতিদিন জনসংখ্যার চাপও বাড়ছেই। জনসংখ্যার এই অতিরিক্ত চাপ ঈদের আগের দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। রমজান উপলক্ষে ফুটপাথগুলোতে ভিড় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক’দিন পরেই দায় পড়বে ফুটপাথে চলাচলও। ইতোমধ্যে রাজধানীতে হকারদের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন হকার ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ফুটপাথ দখল করে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজাচ্ছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার কেন্দ্রস্থল গুলিস্তানের হকার্স মার্কেটগুলো ইতোমধ্যে জমে উঠেছে। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার সংলগ্ন ফুটপাথে ব্যবসা করেন কিশোরগঞ্জের আলফু মিয়া। বাড়িতে তিন সন্তান নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার। কৃষি কাজ করেই পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করেন। কিন্তু বর্ষার এ সময়টিতে গ্রামে তেমন কোন কাজ নেই। অন্যদের মতো ঈদ আয়োজন করতে না পারলেও দুটো ডাল-ভাত জোটাতেই ঢাকায় এসেছেন। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের ফুটপাথে রোজার শুরু থেকে পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন মিরাজুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব থানায়। বাড়িতে মা-বাবা, তিন বছরের কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে মিরাজুলের সংসার। এলাকায় কাজের সংস্থান না থাকায় ঢাকায় এসেছেন কিছুটা আয় রোজগার করতে। উঠেছেন ছোট বোনের বাসায়। জানালেন, এক মাসের জন্য ঢাকায় এসেছেন। গ্রামে ফিরবেন ঈদের দিন। কিছুটা বাড়তি আয়ের আসায় গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় এসেছেন ইয়াছিন মিয়া। বললেন, এলাকায় এখন তাঁর কোন কাজ নেই। একমাস পর ঈদ। স্ত্রী, সন্তানদের জন্য ঈদে কিনতে হবে নতুন পোশাক। ঈদের বাড়তি আয় দিয়ে চলতে হবে আরও ক’মাস। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দে মেতে উঠবেন সবাই। আর এই উৎসব রঙ্গিন করতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থযোগ হচ্ছে অর্থনীতিতে। চলতি বছরের গত এপ্রিল মাস শেষে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৩৩ কোটি ডলার; যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি ডলার বা ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। উৎসবের বর্ণিল মাত্রা যোগ করতে বাজারে আসছে নতুন টাকা। এখন চলছে টাকা ছাপানোর কাজ। রমজানের মাঝামাঝিতে ব্যাংকগুলোতে নতুন চকচকে নোট সরবরাহ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে নোট জালকারী চক্রের সদস্যদের থেকে জনসাধারণকে রক্ষা ও সচেতন করতে গত কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এবারও জালনোট প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের সব তফসিলী ব্যাংকে রমজান মাস জুড়ে জনসমাগমস্থলে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ভিডিও চিত্র প্রচারসহ কয়েকদফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়েছে, যা দেশের সব তফসিলী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। চড়া দাম ইফতার সামগ্রীর ॥ রমজান মাসে সাধারণত ইফতারের তালিকায় থাকে খেজুর, পেয়াজু, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি, হালিম, জিলাপি ও বুন্দিয়া। এছাড়াও থাকে বিভিন্ন ধরনের ফল, চিড়া ও মুড়ি। কিন্তু রমজানকে কেন্দ্র করে এসব পণ্যের বাজার বেশ উত্তপ্ত। দাম বেড়েছে হু হু করে। গত একবছরে দাম বেড়েছে দুই থেকে আড়াই গুণ। গতবার যে মূল্য ছিল এবার সেগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে কোন কোন পণ্যের দাম বেড়েছে শতভাগ। তবে রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে ইফতারির খ-কালীন দোকানগুলোতে ইফতারির দাম হোটেল রেস্তরাঁর চেয়ে কম। অবশ্য এখানেও দাম আগের চেয়ে একটু বেশি। আবার দাম ঠিক থাকলেও আকারে ছোট হয়েছে গতবারের চেয়ে। দাম বেড়ে যাওয়ায় দোকানিদের সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা। এ নিয়ে বিক্রেতারাও অস্বস্তিতে। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজানে বেশির ভাগ পণ্যেরই দাম বেড়ে গেছে। বাজার মনিটরিং ও পণ্যমূল্য তদারকির অভাবে নিত্যপণ্যের বাজার টালমাটাল হচ্ছে বলে মনে করেন দোকানদাররা। তাদের মতে, স্বাভাবিক সময়ের বাজারের চেয়ে রমজান ঘিরে ক্ষেত্রবিশেষে ইফতার সামগ্রীর দাম ৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া খেজুর, ফলসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। রমজান মাসে সাধারণত বেশির ভাগ এলাকাতেই ইফতারের সময় খেজুর মুখে দিয়ে রোজা ভাঙেন রোজাদাররা। সেই খেজুরের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। বাজারে ১০ কেজির খেজুরের কার্টনে ২ শ’ টাকা করে বেড়েছে। প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। খেজুর বিভিন্ন ক্যাটাগরির আছে। সর্বনিম্ন ২ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কেজি রয়েছে। তবে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা দরের খেজুরই বেশি কিনছেন ক্রেতারা।
×