ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত প্রকল্প

কৃষকদের ক্ষতিপূরণের টাকা ভুয়া নামে দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ২১ মে ২০১৮

কৃষকদের ক্ষতিপূরণের  টাকা ভুয়া নামে দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে!

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ২০ মে ॥ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ভুয়া কৃষকদের দেয়ার জন্য মন্ত্রী চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিব্রত প্রশাসনের কর্মকর্তারা। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প এলাকার কৃষকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার ২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এই ২৮ কোটি টাকা ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের এ্যাকাউন্টে জমা আছে। কিন্তু প্রকৃত কৃষকদের এখন পর্যন্ত টাকা প্রদান করা যায়নি। কারণ আগে যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তাতে ভুয়া কৃষকের নাম পাওয়া গেছে। ভুয়া কৃষকের তালিকা তৈরি করে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করার ঠিক আগ মুহূর্তে অভিযোগ উঠলে উক্ত টাকা প্রদান বন্ধ করে নতুন করে সঠিক তালিকা তৈরির জন্য উর্ধতন কর্র্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (মোহাম্মদ আল মামুন) প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি জরিপ কমিটি করা হয়। পরে আরও দুইজনকে উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উক্ত কমিটিতে কৃষি অফিসার, বন কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, পুলিশসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আছেন। দলীয় নিজের পছন্দের লোক ও আত্মীয়দের কৃষক বানিয়ে চলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্পের ২৮ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা চালানো হয়। একটি দৈনিকে এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের একটি সঠিক তালিকা তৈরির তাগাদা দেয়। নতুন জরিপ করে কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পূর্বে করা তালিকা সম্পর্কে কারও অভিযোগ থাকলে তা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করার জন্য মাইকিং করা হয়। কিন্তু তর সইছে না এই এলাকার সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর। তিনি রবিবার ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আল মামুনকে ডেকে নিয়ে কৈফিয়ত তলব করেন কেন নতুন করে মাইকিং করা হলো এবং কৃষকদের টাকা প্রদান করা হচ্ছে না? নির্বাহী অফিসার মন্ত্রীকে বলেন, কৃষকদের সঠিক তালিকা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত টাকা ছাড় দেয়া সম্ভব না। এতেই ক্ষুব্ধ হন মন্ত্রী। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী নির্বাহী অফিসারের সময় পুনঃতালিকাকরণ কাজ শুরু হয়। নতুন নির্বাহী অফিসার নতুন করে জরিপ শুরু করেছেন তার জরিপ দলের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে। পদ্মা নদীর ধু ধু বালুচর, পদ্মার কোলকে দেখানো হয়েছে পেঁপে ও কলার বাগান। অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারী টাকা আত্মসাতের প্রচেষ্টা রোধে এলাকাবাসী, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সরকারের বিভিন্ন দফতরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে খবর প্রকাশের পর টনক নড়ে উপরের মহলের। এই প্রকল্পের জন্য গ্রহণকৃত জমির মালিক বলে দাবিদার, আবাদি কৃষকরা চিরকালের জন্য চাষাবাদ থেকে বঞ্চিত হলেও ক্ষতি পূরণের তালিকায় তাদের নামের পরিবর্তে অন্যদের নাম! ক্ষতি পূরণের জন্য পূর্বে জমা দেয়া তালিকায় পাকশী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস একক ক্ষমতা বলে একাধিক স্থানে নিজের ভাতিজা, আত্মীয়, বাড়ির কাজের লোক, মোটরসাইকেলের চালক, দলের লোকজন যারা নির্বাচনের সময় তার পক্ষে কাজ করেছে তাদের নাম কৃষক হিসেবে তালিকায় দেখানো হয়েছে। এদের প্রত্যেকের নামে কমপক্ষে ৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। যারা কোন দিনই চাষাবাদও করেনি কিংবা জমির মালিকও ছিল না। এদের মধ্যে রয়েছে চেয়ারম্যানের ভাতিজা আব্দুল্লাহ আল কাফি ওরফে আরজু বিশ্বাসের নামে ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫২০ টাকা, আত্মীয় মৃত কেরুর ছেলে আদম আলীর নামে ৩৫ লাখ ৪ হাজার, রহমান সরদারের ছেলে চেয়ারম্যানের ড্রাইভার মন্টু সরদারের নামে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এছাড়াও তার আত্মীয় মহাম্মদ মোল্লার ছেলে তপন মোল্লার নামে ৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, করিম প্রামাণিকের ছেলে সিরাজুল ইসলামের নামে ৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, চেরু প্রামাণিকের ছেলে মুুকুল প্রামাণিকের নামে ৮৭ হাজার টাকা, চেরু প্রামাণিকের অপর ছেলে সজলের নামে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, নজরুলের ছেলে জুয়েলের নামে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭০০ টাকা, ইয়াসিনের ছেলে চান্নুর নামে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, করিমের ছেলে সিরাজুলের নামে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, উম্মেদ আলীর ছেলে বাদশার নামে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, মহসিন খার ছেলে আঃ রশিদ খাঁর নামে ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৬০০ টাকা, রশিদ খাঁর ছেলে লতিফের নামে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, আবুল হোসেনের ছেলে ওবাইদুর রহমান সুজা ম-লের নামে ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা, আবুল ম-লের ছেলে রুবেল ম-লের নামে ৯ লাখ ৪১ হাজার ৪০০ টাকা, সামাদের ছেলে শিপনের নামে ২৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, মহসিনের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমের নামে ১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, হবিবুল ইসলামের ছেলে সেলিম আহমেদের নামে ৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, ইসলাম খাঁর ছেলে মালেক খাঁর নামে ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৮৮৫ টাকা, শহিদুলের ছেলে লালনের নামে ২৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, ভোলা মালিথার ছেলে জিয়ার নামে ৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, মফেজ্জল ম-লের ছেলে পিপলুর নামে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা, চেরুর ছেলে সজলের নামে ১১ লাখ ৯ হাজার ৮শ’ টাকাসহ মোট ১২৪ জন নিজ আত্মীয়কে ভুয়া কৃষক বানিয়ে তালিকাভুক্ত করেছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের সাইড অফিস সূত্র মতে, এই প্রকল্পের জন্য পদ্মা নদী তীরবর্তী কিছু আবাদি, পদ্মাচরের স্বল্প সময়ে উৎপাদিত সবজির মাঠ, অনাবাদি বালু চর ও পদ্মা নদীর কোল (ক্যানেল) বর্তমানে চররূপ কণিকা মৌজার অধীনে ৯৯৬ একর গ্রহণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমি পদ্মা নদীর চর যার পুরোটাই খাস খতিয়ানভুক্ত। যদিও খাস জমি তারপরও সরকার এ ব্যাপারটি মানবিক মনে করে দীর্ঘদিন চাষাবাদ করছেন যেসব কৃষক তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই খাস জমিতে রূপপুর ও দাদাপুর এলাকার কিছু কৃষক চাষাবাদ করত। পূর্বের কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি কালে দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তালিকা তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর দুই চেয়ারম্যানসহ অন্যদের স্বাক্ষরিত ৯৯৬ একর জমির অধিনে ৭৭৫ জন কৃষকের নামে ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ টাকার চাহিদা সংবলিত তালিকা অফিসে জমা দেয়া হয়। এই তালিকায় নানা রকম অনিয়ম করার বিষয়টি এখন উঠে আসে। এ তালিকার বিষয়ে পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম জানান, তালিকায় শতকরা ৭০ ভাগ ভুয়া কৃষকের নাম রয়েছে। এটা একটি আত্মীয়করণ তালিকা। তিনি কৃষক নন, তারপরও তার নাম ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা রয়েছে। এতে তিনি অবাক হয়েছেন। প্রকৃত কৃষক এক টাকার স্থলে ১০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাক, মেনে নেয়া যাবে। কিন্তু ভুয়া কৃষক টাকা পাবে এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বিষয়টিতে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হবিবুল ইসলাম হব্বুল জানান, তালিকাটিতে আত্মীয় ও দলীয়করণ করা হয়েছে। এতে দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। কারণ এই নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। তালিকা বাতিল করে পুনরায় প্রকৃত কৃষকদের নামে তালিকা করার জন্য দাবি জানান এই নেতা। পূর্ববর্তী জরিপ সম্পর্কে উপজেলা বন কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বলেন, তালিকা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কমিটিতে নাম রাখা হয়েছে তাই স্বাক্ষর করেছেন মাত্র। কারা ভুয়া আর কারা আসল কৃষক তার তিনি জানেন না বলে দাবি করেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, পদ্মা নদীর কোলকেও পেঁপের জমি হিসাবে দেখানো হয়েছে। যেখানে মাছ থাকার কথা ছিলো। কমিটিতে নাম রাখায় স্বাক্ষর করেছেন মাত্র। এর বাইরে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ রওশন জামাল বলেন, কৃষকদের তালিকার বিষয়ে তিনি জানেন না। তিনি শুধু সবজির বাজার নির্ধারণ করে দিয়েছেন মাত্র। লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরিফ বলেন, ‘প্রকল্পের জায়গায় চাষাবাদ করা সকলের বাড়ি পাকশী ইউনিয়নের মধ্যে। তাই সেখানকার চেয়ারম্যান একক ক্ষমতা বলে করেছেন।’ তবে তালিকায় ভুয়া কৃষকদের অসংখ্য নাম রয়েছে বলে তিনি বর্তমানে জানতে পেরেছেন। তিনি সঠিক তালিকা করার জন্য দাবি জানান। পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাসের আগে বলেন, তালিকায় তিনি কোন আত্মীয়করণ করেননি। যারা কৃষক তাদের নামই দিয়েছেন। তবে তালিকা প্রস্তুতকালে দলের কিছু নেতাকর্মী অফিসে এসে আনাগোনা করত, রাজনীতি করার কারণে তাদের কয়েকজনের নাম দেয়া হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যাদের বাড়ি রূপপুরে নয় তাদের এবং কিছু মানুষ যারা নিজেদের নাম অনিয়মের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করতে বলে ছিল তাদের নাম না থাকায় তারাই এসব মিথ্যা অপ্রচার করা হয়। ঈশ্বরদীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, ‘সঠিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত হলেই ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া যাবে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যাতে ক্ষতিপূরণের অর্থ পান সে জন্য তিনি সঠিকভাবে জরিপ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারী অর্থ কোনভাবেই যেন তছরুপ না হয় সেটাও দেখতে হবে।
×