ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দৈনিক আড়াই হাজারের ইফতার, ধনীর দুলাল ভবঘুরে সবার এক মর্যাদা

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২১ মে ২০১৮

দৈনিক আড়াই হাজারের ইফতার, ধনীর দুলাল ভবঘুরে সবার এক মর্যাদা

মোরসালিন মিজান ॥ কেউ সম্ভ্রান্ত। কেউ ছিন্নমূল, ভবঘুরে। ধনী কেউ। কেউ হতদরিদ্র। কিন্তু সবাই একসঙ্গে পাশাপাশি বসছেন। ইফতার করছেন। মাথা গুনলে আড়াই থেকে ৩ হাজারের কম হবে না। এত এত মানুষের ইফতার যে সে কথা নয়। অনেকে নিশ্চিত চমকে উঠবেন। অথচ বায়তুল মোকাররম মসজিদের পূর্ব শাহানে প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে দৃশ্যটি। দেশের সবচেয়ে বড় ইফতার আয়োজনটি করছে সরকারী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রতিবারের মতো এবারও রমজানের প্রথম দিন থেকে চলছে ইফতার আয়োজন। রোজাদারদের প্রত্যেককে অতিথি জ্ঞান করে তাদের জন্য বিনা খরচে ইফতারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আরও উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছেÑ এখানে সবাই সমান মর্যাদার। ধনী-দরিদ্রের কোন পার্থক্য করা হচ্ছে না। আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই কারো জন্য। মূল আয়োজনটি হচ্ছে মসজিদের পূর্ব শাহানে। এখানে প্রায় ২০ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গাজুড়ে রোজাদারদের বসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রতিদিন আসরের নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে থালা বাটি সাজানো গুছানোর কাজ। রোজাদাররা নিজ হাতে বিভিন্ন কাজ করছেন। একই সময় চলছে বয়ান। অপেক্ষাকৃত প্রবীণরা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। এভাবে ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। বাড়ছে ইফতার করতে আসা লোকজনের সংখ্যা। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী, আশপাশের দোকানদার, গুলিস্তান এলাকায় কেনাকাটা করতে আসা সাধারণ মানুষ, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, এতিম-মিসকিন সবাই এসে পাশাপাশি বসছেন। সত্যি দেখার মতো দৃশ্য। ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা। বিরাট কর্মযজ্ঞ তদারকি করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ ও মার্কেট বিভাগ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার ইফতারে প্রতিদিন খেজুর থাকছে ৭০ কেজি। ছোলা মুড়ি বেগুনি না হলেই নয়। ৬০ কেজি মুড়ি, ১০০ কেজি ছোলা, ৭০ কেজি পেঁয়াজু, ৭০ কেজি বেগুনি থাকছে প্রতিদিন। প্রতিদিন ৫০ কেজি শসা রাখা হচ্ছে ইফতারে। মিষ্টিও বাদ যাচ্ছে না। থাকছে ১০০ কেজি জিলাপি। প্রতিদিন চিনি ব্যবহার হচ্ছে ৪৫ কেজি। ফলের মধ্যে থাকছে কলা। ১৫০০ কলা অর্ধেক করে কেটে পরিবেশন করা হচ্ছে। তার আগে গলা ভিজানোর জন্য রাখা হচ্ছে ২০ বোতল শরবত। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইফতারে খাবার পরিবেশনের জন্য রয়েছে সাড়ে ৩০০টি বড় ডিশ। প্রতিটিতে ৬ থেকে ৭ জনের ইফতার করার ব্যবস্থা রয়েছে। রোজাদাররা ডিশের চারপাশে চমৎকার গোল হয়ে বসে ইফতার করছেন। মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের জন্য ইফতারের পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে নামাজকক্ষে প্রতিদিন শতাধিক মহিলা ইফতার করছেন বলে জানা যায়। এখানেও ভেদাভেদহীন। এখানেও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটি আয়োজন। বিশাল এই আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিদিন কাজ করছেন মসজিদের ২০ জন খাদেম ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন ১০ থেকে ১৫ জন সাধারণ মুসল্লি। এভাবে কাজটিও ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন সবাই। রবিবার ইফতারের আগে কথা হয় হাবিব নামের এক যুবকের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমার বাসা মিরপুরে। দুপুরে গুলিস্তানে কাজ ছিল। শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেছে। তাই এখানে ইফতার করতে আসা। রেস্তরাঁ বসে ইফতার করা যেত। কিন্তু এখানে অনেক গরিব মানুষ আসেন। তাদের সঙ্গে বসে ইফতার করার একটা আলাদা তৃপ্তি। এ কারণেই বায়তুল মোকাররমে ইফতার করা বলে জানান তিনি। শহীদ নামের এক ভবঘুরে কিশোর স্বীকার করলো যে, সে রোজা রাখেনি। কিন্তু ইফতার করতে এসেছে। তার ভাষায়- ‘আইজকা রোজা রাখতে পারি নাই। ঘুমাইছিলাম। উইট্টা দেহি, দিন হয়া গেছে।’ তবে রোজা না রাখলেও সারাদিন কিছু তেমন খাওয়া হয়নি তার। বলল, ‘ক্ষুধা লাগছে। কেউ খাইতে দেয় না। এইখানে দেয়। তাই আইছি।’ কথা শুনে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। আবার ভাল লাগল এই ভেবে যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন শহীদের মতো ভাগ্য বঞ্চিতদের জন্য এমন চমৎকার একটি ব্যবস্থা রেখেছে। আয়োজনটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ মহিউদ্দিন মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, এবার একেবারে প্রথম দিন থেকেই আড়াই থেকে তিন হাজার রোজাদার আসছেন। ইফতার করছেন। কেউ কারও পূর্ব পরিচিত নন। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। কিন্তু কোন বৈষম্য নেই। সবাই মিলে মিশে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে ইফতার করছেন। বেশি মানুষ একসঙ্গে ইফতার করলে সোয়াব বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণেও অনেকে এখানে ইফতার করতে আসেন। ইফতারের আয়োজন রোজার শেষ দিন পর্যন্ত চালু থাকবে বলে জানান তিনি।
×