ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শংকর লাল দাশ

ধান উৎপাদনে সফলতা

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ২০ মে ২০১৮

ধান উৎপাদনে সফলতা

প্রতিবছর দেশে বিভিন্ন কারণে চাষের জমি কমছে। কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের হারও কমছে। অথচ এরপরেও ফসল উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে। বিশেষ করে প্রধান ফসল ধান উৎপাদন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। এক ফসলি জমি তিন ফসলিতে রূপ নেয়ার পরিমাণও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যশস্য নিয়ে প্রকাশ করা সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ৪৫ বছরে ধান উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। এক সময়ের খাদ্য ঘাটতি এখন উধাও হয়ে গেছে। ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে দেশে ধান উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৮ লাখ ৬৮ হাজার টন। ৪৫ বছরের ব্যবধান ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ এক হাজার টনে। এ সময়ের ব্যবধানে হেক্টর প্রতি উৎপাদনও তিনগুণের বেশি বেড়েছে। অথচ ৪৫ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের সামান্য বেশি। ফসল বিশেষত ধান উৎপাদন বাড়ার নেপথ্যে সরকারের কৃষিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়ন ও কৃষকদের আন্তরিকতায় সম্ভব হয়েছে বলে পরিসংখ্যানে দৃশ্যমান হচ্ছে। ভাটির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ আবহমান কাল থেকে কৃষিনির্ভর। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা চাষাবাদ। আজও এ অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে দেশে চাষ যোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিবছর হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি জমি সংক্রান্ত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৭২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৬ একর জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। অকৃষি খাতে চলে যাওয়া জমির মধ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৮৯ একর জমিতে। দোকান নির্মাণ হয়েছে ৬ হাজার ২৬২ একর জমিতে। বাকি জমিগুলোতে কল কারখানাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কৃষি জমি বিলুপ্তির প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী প্রতিবছর দেশের প্রায় ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। আরেক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জমির পরিমাণ হলো ৩ কোটি ৩৪ লাখ একর মতান্তরে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার একর। বাংলাদেশে মোট আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর। এরমধ্যে ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর অর্থাৎ শতকরা হিসেবে প্রতিবছর এক ভাগ আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। একইভাবে কমছে কৃষিতে কর্মসংস্থান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরেক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে ২ কোটি ৬২ লাখ মানুষ কৃষিখাতে নিয়োজিত থাকলেও এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে তা কমতে শুরু করে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা ২ কোটি ৪৭ লাখে নেমে আসে। কৃষিতে কর্মসংস্থান সম্পর্কিত আরেক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ১৯৮৩-৮৪ সালে বাংলাদেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে এ সংখ্যা নেমে আসে ৬৬ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশে। কৃষি জমি এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার প্রবণতার পরেও কৃষক সমাজ দেশকে খাদ্যে বিশেষত ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের কৃষিবান্ধব কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যশস্য সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৭০-৭১ সালে দেশে আমন চাষ হয় ৫৭ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। এতে ফসল আসে ৫৮ লাখ ১৩ হাজার টন। আউশ চাষ করা হয় ৩১ লাখ ৯১ হাজার হেক্টর জমি। এতে উৎপাদন হয় ২৮ লাখ ৬৩ হাজার টন। বোরো চাষ হয় ৯ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমি। যাতে উৎপাদন হয় ২১ লাখ ৯২ টন। অর্থাৎ ওই বছর মোট ৯৯ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে এক কোটি ৮ লাখ ৬৮ হাজার টন ধান উৎপাদন হয়। এর এক দশক পরে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে আমন চাষের জমি কিছুটা বেড়ে ৬০ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। এতে উৎপাদন হয় ৭৮ লাখ ৩৭ হাজার টন। একই বছরে কিছুটা কমে আউশের চাষ ৩১ লাখ ১২ হাজার হেক্টরে। জমি কমলেও ধান উৎপাদন বেড়ে ৩২ লাখ ৩৫ হাজার টনে পৌঁছে। একই বছরে আবার বোরোর চাষ যেমন বাড়ে, তেমনি ধানের উৎপাদনও বেড়ে যায়। ১৩ লাখ ২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদন হয় ২৫ লাখ ৮৯ হাজার টন। ওই অর্থবছরে মোট এক কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার হেক্টর জমিতে এক কোটি ৩৬ লাখ ৬১ হাজার টন ধান ফলে। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে এক কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে এক কোটি ৭৮ লাখ ৫২ হাজার টন এবং ২০০০-০১ অর্থবছরে ১ কোটি ১২ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টরে ২ কোটি ৫০ লাখ ৮৬ হাজার টন ধান উৎপাদন হয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মাথায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক কোটি ১৪ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে তিন কোটি ৪৭ লাখ এক হাজার টন ধান উৎপাদন হয়। এ সময়ের ব্যবধানে গড় হেক্টর প্রতি উৎপাদনেও ব্যাপক সাফল্য আসে। এক্ষেত্রে আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে- ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। যা কৃষকদের যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর থেকে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৮-৯৯ পর্যন্ত কোন বছরেই হেক্টর প্রতি ধানের গড় উৎপাদন ২ টনে পৌঁছেনি। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে প্রথম বারের মতো ধানের উৎপাদন হেক্টর প্রতি গড়ে ২ দশমিক ১৫৪ টনে পৌঁছে। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে তা তিন টন ছাড়িয়ে যায়। ২০১৪-২৫ অর্থবছরে ধানের ফলন আসে প্রতি হেক্টরে তিন দশমিক ৪১ টন। জনসংখ্যা বাড়ছে। আবাদি জমি কমছে। কৃষিতে কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। অথচ এরপরেও বাংলাদেশে ধানের ফলন বাড়ছে। যা পৃথিবীর অনেক দেশের কাছে এক বিস্ময়ের বিষয়। খাদ্য ঘাটতি থেকে ক্রমে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসছে। খাদ্য উদ্বৃত্তের তালিকায় বাংলাদেশ ক্রমে শক্ত অবস্থান তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে এরই মধ্যে উধাও হয়ে গেছে উত্তরের মঙ্গা আর দক্ষিণের আকাল। না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় হাতে গোনার মধ্যে চলে এসেছে। পরিসংখ্যান সহজেই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের কৃষক এগোচ্ছে। কৃষি এগোচ্ছে। আর সমানতালে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।
×