ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সারাদেশে দুই শতাধিক গডফাদারের তালিকা তৈরি, চলবে আরও সাঁড়াশি অভিযান

এবার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, র‌্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৯

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২০ মে ২০১৮

এবার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, র‌্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৯

শংকর কুমার দে ॥ মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুক্রবার রাতে যশোরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এ দিকে শনিবার পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় ছয় মাদকসেবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই নিয়ে গত পনেরো দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে ৯ মাদক ব্যবসায়ী নিহত আর একহাজারেরও বেশি মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার এবং দুই শতাধিক মাদকসেবীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়ার ঘটনা ঘটল। সারাদেশে প্রতি বছর মিয়ানমার, ভারতসহ বিদেশ থেকে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে ১০ হাজার কোটি টাকার সর্বনাশা নীল নেশার মাদক। এসব মাদকের মধ্যে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ, কোকেন, সীসা ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনের সংখ্যাই বেশি। মাদক উৎপাদনসহ অবৈধ কারবারের সঙ্গে লক্ষাধিক লোক জড়িত। আর সারাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জঙ্গীবাদের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে মাদক। তাই যে কায়দায় জঙ্গী দমন করে সফলতা অর্জিত হয়েছে, সেই কায়দায় জিরো টলারেন্স নীতিতে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযান আরও জোরাল হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে। গত ৩ মে র‌্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে র‌্যাব সদর দফতরে জঙ্গীবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে কড়া অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব যেভাবে অভিযান চালিয়ে সাফল্য অর্জন হয়েছে, এখন মাদকের বিরুদ্ধেও সেভাবে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। পুলিশ সদর দফতর বলছে, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পর পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি ও র‌্যাব মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে মাদক নির্মূলে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কড়া নির্দেশ জারি করেন। সেইসঙ্গে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের জেল জরিমানা করার কথাও বলা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদকের সঙ্গে জড়িতদের জেল জরিমানা করছে। দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৭ ভাগই পুরুষ। বাকিদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। মাদকাসক্ত শিশুদের সংশোধনাগারে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। সূত্র বলছে, দেশে মাদক ব্যবসার সঙ্গে দুই শতাধিক গডফাদার জড়িত। তাদের তালিকা করা হয়েছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। আর সারাদেশে খুচরা মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা কয়েক লাখ। মাদকের কারণে দিন দিন দেশে নানা ধরনের মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনা ঘটছে। র‌্যাব সদর দফতর বলছে, অভিযানের ধারাবাহিকতায় শুক্রবার রাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলায় বাগদাহ গ্রামের কদমতলা এলাকায় র‌্যাব-৬ এর সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের বন্দুকযুদ্ধে তিন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। নিহতরা হচ্ছে অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের কাদের আলী মোড়লের ছেলে আবুল কালাম (৪৭), একই গ্রামের আব্দুল বারিক শেখের ছেলে হাবিবুর রহমান (৩৮) ও আব্দুস সাত্তার কাসারির ছেলে মিলন কাসারি (৪০)। নিহতদের কাছ থেকে মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল, দুইটি পিস্তল, ৫শ’ বোতল ফেনসিডিল, একটি চায়নিজ কুড়াল ও গুলিভর্তি একটি ম্যাগজিন উদ্ধার হয়েছে। র‌্যাব-৬ খুলনা ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে কর্নেল মোহাম্মদ জাহিদ সাংবাদিকদের জানান, র‌্যাবের একটি চেকপোস্টে তল্লাশি অভিযানকালে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটি ঘটে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত আবদুল আলীম শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিল। এর আগে র‌্যাবের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নারায়ণগঞ্জে ছয় মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। র‌্যাব বলছে, বিশেষ অভিযানে গত ১৫ দিনে গ্রেফতার হয়েছে দেড় হাজারের বেশি ব্যবসায়ী। আর সাজা দেয়া হয়েছে দুই শতাধিক মাদকসেবীকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে কয়েক লাখ পিস ইয়াবা। সারাদেশে র‌্যাবের মাদকবিরোধী শতাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯১ ভাগ কিশোর ও তরুণ। যাদের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। মাদকাসক্তের মধ্যে ১৫ ভাগ উচ্চশিক্ষিত। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পৃথক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে সুঁই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এ মাদকাসক্তরা শিরায় মাদক গ্রহণ করায় এইচআইভি ঝুঁকির মধ্যে থাকে বেশি। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, প্রকৃতপক্ষে দেশে কত টাকার মাদক লেনদেন হচ্ছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকার মাদক বেচাকেনা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তের চোরাইপথ দিয়ে আসা মাদকে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশ। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ ধরনের খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। কেবলমাত্র রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় ২ হাজার পাইকারি ও খুচরা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের তৈরি তালিকা ধরেই মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট, কুমিল্লা, আখাউড়া, চট্টগ্রামের সীমান্ত পথ দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ফেনসিডিল ও হেরোইন আসছে এবং উদ্ধারের ঘটনাও ঘটছে। বাসে ও ট্রেনে মাদকদ্রব্য বিভাগ ও জেলা শহরগুলো থেকে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করছে। আকাশ পথে বিমানবন্দর দিয়ে মাঝে মধ্যেই প্রবেশ করছে হেরোইন। অজ্ঞানকারক ওষুধ হিসেবে আমদানি করা প্যাথেড্রিন, মরফিন জাতীয় দ্রব্য মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অবাধে ও প্রকাশ্যে। পুলিশ সদর দফতর থেকে দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার, রেঞ্জ ডিআইজি ও মহানগর কমিশনারদের কাছে যে বার্তা পাঠানো হয়েছে তাতে মাদক ব্যবসার গড ফাদার থেকে শুরু করে যারাই মাদকে যুক্ত তাদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের কর্মকর্তা জড়িত তাদেরও গ্রেফতার করা হবে। মাদকের উদ্ধারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট নতুন করে সাজানো হয়েছে। অপরাধ বিশেষেজ্ঞরা বলেছেন, কিশোর বয়সে মাদকের হাতছানি ভয়ঙ্কর বিপদজ্জনক। এই সময়টাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী বয়সের সন্তানরা। একবার এই পথে পা বাড়ালে আর ফেরানো অনেক কষ্টকর। যারা মাদক ছড়াচ্ছে তাদের মূলে আঘাত করতে হবে। তা না হলে সমাজ ভেঙ্গে পড়বে। নানা কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণে মূল্যবোধের যে ঘাটতি হচ্ছে তা কেউ খেয়াল করছে না। সামাজিক বিধি-বন্ধন থাকছে না। ফলে সমাজ ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। বিপথগামী হয়ে পড়ছে সন্তানরা। সর্বনাশা মাদকের নীল নেশায় ঐশীর মতো তরুণ প্রজন্ম জন্মদাতা মায়াময়ী মা-বাবা হত্যার মতো নিষ্ঠুর নির্মম ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হচ্ছে না।
×