ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মূল সমস্যা চার পয়েন্টে ॥ অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়ক

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৯ মে ২০১৮

মূল সমস্যা চার পয়েন্টে ॥ অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা- চট্টগ্রাম  মহাসড়ক

রাজান ভট্টাচার্য ॥ যানজটে অচল দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কে দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চললেও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকার অগ্রধিকার ভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন নির্মাণ করে। আশা ছিল এই নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই সড়কে কোন সমস্যা হবে না। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই সমস্যা চলছিল। যা এখন আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রশ্ন হলো সংকটের কারণ নিয়ে। চালক, মালিক যাত্রীসহ হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যানজটের মূল কারণ হলো ফেনী শহরের ফতেপুরে রেলওয়ের ওপর ওভারপাস নির্মাণ। বিশাল এই নির্মাণযজ্ঞে চার লেনের সড়ক হয়েছে এক লেন। তাই যানজট চরম আকার ধারণ করেছে। অন্য কারণ সমূহের মধ্যে রয়েছে, দাউদকান্দি ও মেঘনা সেতুর দুটি টোল প্লাজা এবং দাউদকান্দির গোমতী সেতুর ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফোর লেন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও সড়কের সঙ্গে সেতু বাড়ানো হয়নি। অর্থাৎ চার লেনের যানবাহনগুলো সেতুর মুখে দুই লেনে গিয়ে ঠেকছে। তাছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। রাস্তা ঠিক রাখতে ভারি যানবাহন ঠেকাতেই ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল বসানো হয়েছিল। এ নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। স্কেলে দায়িত্বপালনকারীদের ইচ্ছেমতো শাসন চলে এখানে। কারণে অকারণে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। টাকা দিলে গাড়ি ছাড়ে। না দিলে বাঁধে জটলা। অর্থাৎ কৃত্রিম জটলায় এই পয়েন্টে যানজট বেড়ে যায়। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, এই সড়কে এখন মহাদুর্ভোগ চলছে। অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজের জন্যই এই দুর্ভোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সমস্যা সমাধানে বারবার সরকারকে বলছি। কিন্তু সংকট তিমিরেই আছে। আসন্ন ঈদেও ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগের আশঙ্কা করেন তিনি। ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ বার সড়ক বন্ধ ॥ পরিবহন চালকরা বলছেন, ফেনী রেল ক্রসিং এলাকায় ওভারপাস নির্মাণের কাজ সহজে শেষ হচ্ছে না। তাই আসন্ন ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ নিশ্চিত বলা যায়। এ বিষয়ে এই পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করা টিআই গোলাম ফারুক বলেন, নির্মাণাধীন ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারপাসের পাশের রাস্তায় বিশটির মতো ছোট-বড় খানাখন্দ রয়েছে। ফেনী শহরের পুরাতন এ্যাপ্রোচ সড়কটি মেরামত না হওয়ায় ওই পথে কোন গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। এ ছাড়া, ফতেপুরে রেলক্রসিং দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য চব্বিশ ঘণ্টায় ৪৬ বার সড়ক বন্ধ করে ফের চালু করতে হয়। ফলে ক্রসিংয়ে একটি গাড়ি পার হতে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগে। তিনি জানান, ফেনী পুলিশ সুপারের নির্দেশে জেলা ও হাইওয়ে পুলিশ যানজটে আটকা থাকা গাড়িগুলো মুক্ত করতে দিনরাত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। স্টার লাইন পরিবহন গ্রুপের পরিচালক মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, দিন দিন এখানে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন পরিবহন ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। ছয় ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লাগছে ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা। যাত্রী ও চালকরা জানান, ফতেপুরে মাত্র এক লেনের রাস্তার কারণে এই অংশে যান চলাচলে সীমাহীন যানজটের সৃষ্টি হয়। আবার ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় যানবাহন চলাচল আটকে দেয়া হয়। ফলে দু’পাশে শত শত গাড়ি আটকা পড়ে। ছয় বছরে ওভারপাসের অগ্রগতি ৫০ ভাগ ॥ ফেনী সড়ক ও জনপথ বিভাগের সূত্র জানায়, মহাসড়কের ফতেপুরে ২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি ওভারপাস নির্মাণে কাজের অনুমতি পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড (পিবিএল)। এই প্রতিষ্ঠানটি একই সঙ্গে কুমিল্লা, ফেনী ও ইলিয়টগঞ্জে ওভারপাসের নির্মাণ কাজ শুরু করে। ফেনীর ফতেপুর মূল রেল ওভারপাসের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮৬ দশমিক ৭৯ মিটার। দুদিকের ঢালু অংশ মিলিয়ে মোট দৈর্ঘ ৭৫৫ মিটার। ঢাকার অংশের দৈর্ঘ্য ৩৪৭ মিটার আর চট্টগ্রাম অংশের দৈর্ঘ ৪০৮ মিটার। পিবিএল কাজ পাবার পর থেকে নানা টালবাহানা শুরু করে। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে কাজের পর ফেনী রেলওয়ে ওভারপাসের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি মাত্র ৫০ ভাগ। চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ২০১৬ সালে প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা উত্তোলন করে পালিয়ে যায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পিবিএল। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে চাঁদার দাবিতে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালায় বলে থানায় অভিযোগ আনা হয়। পিবিএলের ইঞ্জিনিয়ার জিয়াউর রহমান ফেনী মডেল থানায় ছয় সন্ত্রাসীর নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সে সময় ফতেপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাজন নামে একজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ ঘটনার পর একবছর ধরে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকে। লাপাত্তা হয়ে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এদিকে, জনদুর্ভোগের জন্য ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ পায় মেট্রো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আল আমিন কনস্ট্রাকশন। অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে তারাও। এ প্রতিষ্ঠানকে ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ সময় দিয়ে কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। এই সময়সীমার মধ্যে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার তত্ত্বাবধানে কাজ করছে আল আমিন কনস্ট্রাকশন। গত ৬ এপ্রিল ফতেপুরের রেলওয়ে ওভারপাসের কাজের অগ্রগতি দেখতে ফেনীতে যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি সে সময় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে রেল ওভারপাসের একটি অংশের কাজ সম্পন্ন হলে, তা খুলে দেয়া হবে। বাকি অংশের কাজ জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় নিয়োজিত কর্মকর্তারাসহ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোন তথ্য জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। ফেনী সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান বলেন, বাইপাস সড়ক নিয়ে আর কোন পরিকল্পনা নেই। তবে শহরে প্রবেশের এ্যাপ্রোচ সড়কটি সংস্কার করা হবে। এতে জনদুর্ভোগ অনেকটা কমবে যাবে বলে তিনি দাবি করেন। প্রতিদিন দুর্ভোগ বাড়ছে ॥ সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তায় যানজট হচ্ছে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। পণ্য পরিবহনেও ব্যয় বাড়ছে সমানতালে। যানযট নিরসনে জনভোগান্তি দূর ও বিভিন্ন দাবিতে সোমবার পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক পরিবহন ইউনিয়ন। সমিতির সদস্য সচিব মৃণাল চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ফেনীর ফতেপুর, মেঘনা সেতু, সীতাকুন্ডের বড় দারোগার হাট স্কেলসহ বিভিন্ন স্থানে দুঃসহ যানজট সহনীয় করতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়। চৌদ্দগ্রাম থানা পুলিশের ওসি আবুল ফয়সাল বলেন, যানজট নিরসনে থানা ও হাইওয়ে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেনের জন্য এখন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে দাউদকান্দি ও মেঘনা সেতুর দুটি টোল প্লাজা এবং দাউদকান্দির গোমতী সেতুর ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল। যানজট প্রসঙ্গে ফেনী জেলা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মীর গোলাম ফারুক জানান, ফতেহপুর এলাকায় রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণজনিত কারণে এই সড়কে এক লেনে যানবাহন চলাচল করছে। ফলে চার লেনের যানবাহন এক লেনে চলাচলের কারণে মহাসড়কে যানজট বাড়ছে। এছাড়া সড়কের খানাখন্দ ও বৃষ্টির কারণে যানবাহনের ধীরগতিও যানজটের কারণ। হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম জানান, ফেনী রেলওয়ে ওভারপাসের নির্মাণকাজের কারণে চার লেনের গাড়ি এক লেন দিয়ে চলাচল করায় মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ২৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজা, মুন্সীগঞ্জের মেঘনা ব্রিজ ও ফেনীর রেলক্রসিং এলাকা এখন যানজটের কারণে যানবাহন ও যাত্রী সাধারণের কাছে এক আতঙ্কের নাম। তিনটি পয়েন্টে শুরু থেকেই দুর্ভোগ চলছে। যা এখন মাত্রা ছাড়িয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের পথে কাঁচপুর ব্রিজ অতিক্রম করে প্রথমেই দুর্ভোগে পড়তে হয় মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায়। এরপরই মেঘনা টোলপ্লাজায় টোল গ্রহণে ধীরগতির কারণে মেঘনা সেতুর দুদিকে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন কখনো কখনো মুন্সীগঞ্জ জেলার ভবেরচরসহ মেঘনা ব্রিজের দুদিকে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে যায়। জানা যায়, মেঘনা ব্রিজের উচ্চতা বেশি হওয়ায় পণ্যবাহী ভারি যানবাহন ধীরগতিতে ওই ব্রিজ পাড়ি দিতে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। আবার কখনো কখনো মেঘনা ব্রিজের ওপরই যানবাহন বিকল হয়ে পড়লে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। মেঘনা ব্রিজ পার হওয়ার পরই দাউদকান্দি টোলপ্লাজায় ঢাকা অভিমুখী ভারি যানবাহনের ওজন পরিমাপে ধীরগতির জন্য এ এলাকায় প্রায়ই ১০-১৫ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। সওজ ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ হোসেন জানান, ঢাকা থেকে ফেনী শহরে প্রবেশপথ ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরনো মহাসড়কটিতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় শহরের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এলাকায় সংস্কার কাজ চলায় এ পথেও যানবাহন চলাচল বন্ধ। মহাসড়কে যানজট সৃষ্টির এটাও একটি কারণ। আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে আগামী ২ মাসের মধ্যে কাজ শেষে সড়কটি খুলে দেয়া হবে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর রেলওয়ে ওভারপাসের কাজটি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে বলেও জানান তিনি।
×