ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফা খন্দকার

কেনসিংটন স্যুপ কিচেন থেকে কেনসিংটন প্যালেসের হার হাইনেস

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৯ মে ২০১৮

 কেনসিংটন স্যুপ কিচেন থেকে কেনসিংটন প্যালেসের হার হাইনেস

‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে!’ হেনরি চার্লস এলবার্ট ডেভিড নামে এক কুমার গ্রীক ক্লাসিক্যাল মিথোলজির প্রেমের দেবতা কিউপিডের বাণে বিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েছিলেন সেই ফাঁদে। কিন্তু এটা কি কেবলি কোন একজন সাধারণ কুমারের গল্প? শৌর্যবীর্যের প্রতীক হয়ে দিগন্তের পানে ঘোড়া ছুটিয়ে যার চলা, রাজকীয় যুদ্ধবিমানে যিনি আকাশ বাতাস মথিত করে উড়ে যান মেঘমালার ওপারে, এগল্প হলো সেই একজন রাজপুত্রের প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়ার গল্প। প্রিন্স হ্যারি নামে বিশ্বময় সুপরিচিত এই রাজকুমার ইংল্যান্ডের প্রবল প্রতাপান্বিত কুইন অব ইংল্যান্ডের দৌহিত্র এবং সিংহাসনের এক নম্বর উত্তরাধিকারী প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লস এবং প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানার দ্বিতীয় পুত্র। তিনি জন্মের সময় রাজসিংহাসনে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের তৃতীয় উত্তরাধিকারী ছিলেন। বড় ভাই উইলিয়ামসের তৃতীয় সন্তান জন্ম নেয়ার পর বর্তমানে অবস্থান হয়েছে ষষ্ঠ। মিডিয়া তাকে বলেছিল পৃথিবীর ‘মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর।’ দিন যায় বছর যায় তথাপি নাচের আসরে একপাটি জুতা হারানো কোন সিন্ডেরেলার কাছে মন হারানোর বেলা তার জীবনে আসেনি ৩১টি বছর পর্যন্ত। অবশেষে ৩২ বছর বয়সে প্রেম নিয়ে এলেন অর্ধ কৃষ্ণাঙ্গী মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কল। তার সঙ্গে ভালবাসার পরিণতিতে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রিন্স হ্যারি পরিণয়ের সূত্রে আবদ্ধ হতে যাচ্ছেন আজ। সেই উপলক্ষে আমেরিকাসহ দুনিয়ার বহু দেশে আজ মহোৎসবের বন্যা। একদা যে ব্রিটিশ রাজ্যের সীমানায় সূর্য অস্ত যেত না সেই সিংহাসন অধিষ্ঠিত কুইন অব ইংল্যান্ড অদ্যাবধি কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর ৩৬টি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী যে! হ্যারির পিতা এখনও যিনি রাজসিংহাসনের এক নম্বর উত্তরাধিকারী সেই প্রিন্স চার্লসকে তার পিতা লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি যাকে বিবাহ করবেন তাকে হতে হবে কুমারী এবং অভিজাত বংশের একজন কন্যা। প্রথমবারের মতো যুবরাজ চার্লস এক নীল নয়না ১৯ বছরের রাজকন্যাকে ইতিহাসের এক রূপকথার মতো বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিবাহের কোন মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটেনি। ডায়ানার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটার পর সব নিয়ম ভেঙ্গে প্রিন্স চার্লস পুনর্বিবাহ করেন এক সময়ের পরস্ত্রী ডিভোর্সি প্রেমিকা ক্যামিলাকে। হ্যারির রাজকীয় বিবাহকে রূপকথা বলে অভিহিত করা যায় না বোধহয়। তবে রাজবধূকে মার্কিনীরা আমেরিকান রাজকুমারী আখ্যা দিলেও মেগান আদতেই কোন রাজকুমারী যেমন নন তেমনি নন কুমারীও। ৩৬ বছর বয়সী মেগান মার্কল একজন বিবাহবিচ্ছিন্নকারী রমণী। কালচে রঙের মেগান দীর্ঘদেহী রূপবান প্রিন্সের তুলনায় অনেকটাই বেঁটে। তারপর তিনি হলেন ৩০ বছর আগে বিবাহ সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়া কৃষ্ণাঙ্গী মাতা ও শ্বেতাঙ্গ পিতার কন্যা। প্রিন্স হ্যারি ব্রিটেনের রাজ্ ইতিহাসকে যেন একটি নতুন মোড়ের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। মেগান ২৩ বছর বয়সে জ্যামাইকান সৈকত রিসোর্টে ২০১১ সালে ১০০ জন অতিথিদের সম্মুখে একটি ছোট অনুষ্ঠানে বিয়ে করেছিলেন ইঙ্গেলসন নামে তার প্রেমিক মেন্টর ও এজেন্টকে। অভিনয় স্কুল থেকে বেরিয়ে ইঙ্গেলসনের মাধ্যমেই তিনি রুপালি পর্দায় ঠাঁই পেয়ে চড় চড় করে উঠেছিলেন ওপরে। কাছের বন্ধুরা বলছে প্রথম বিবাহের জীবনে মেগান বলতেন এই স্বামীটি ছাড়া তিনি তার জীবন কল্পনা করতে পারেন না। কিন্তু যখন প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে মোলাকাতের পর প্রেম হলো, তখন এই উচ্চাকাক্সক্ষী রমণীর তখনকার অবস্থানটি বড় তুচ্ছ মনে হয়েছিল যেন এবং পরবর্তীতে ইঙ্গলসনের বিবাহের আংটি ডাক মারফত ফেরত পাঠিয়ে ডিভোর্স করলেন তাকে। এখনও বহু মানুষ পৃথিবীতে আছেন যারা নবজাতক হ্যারিকে দেখেছে হাসপাতালের মূল ফটকে লাল প্রসূতির একটি পোশাক পরিহিত জগদ্বিখ্যাত রাজকুমারী ডায়ানার কোলে। আরও অনেক চিত্রের সঙ্গে এই রাজপুত্রকে দেখেছে পারিবারিক এস্টেটের হাইগ্রোভে নামের গ্রামটিতে। যেখানে স্থায়ীভাবে বাড়ির কোনায় বসবাস করত তার প্রিয় একটি লোপ ইয়ার্ড খরগোশ। এটিকে স্নান করিয়ে দিতেন স্বহস্তে। তার আরও পছন্দ ছিল ইয়ার্ডে চরে বেড়ানো মেষশাবকগুলো।যখন তখন কোলে তুলে নিতেন এগুলোকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বালতির পর বালতি পানি তুলে উইলিয়ামসকে নিয়ে খেলতেন ‘দে গরুর গা’ ধুইয়ের মতো খেলা। তারপর রাজপ্রাসাদ থেকে ক্রন্দসী ডায়ানার চিরতরে বেরিয়ে যাবার সময় প্রাচীরের অন্তরালে দুই রাজপুত্রের আকুল কান্নার ধ্বনি বাতাসের কাছেও গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যেদিন শিশু দুই রাজপুত্র প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পরম আনন্দে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে দূরে দাঁড়ানো মায়ের কাছে, সে ছবি ফটোগ্রাফাররা ছড়িয়ে দিত মিডিয়ায়। কিন্তু ওদের জীবনের দুঃখের ঘট বুঝি পূর্ণ হয়নি। একদিন সমগ্র দুনিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে দেখল মায়ের শবদেহ বহনকারী শকটের পেছন পেছন সেই তারা হেঁটে যাচ্ছে। একদিন প্রিন্স হ্যারি যুক্তরাজ্যের স্কুলগুলো থেকে পাঠ সমাপনের পর শিক্ষা লাভ করতে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায় এবং লেসোথোতে। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডার হাস্টে অফিসিয়াল প্রশিক্ষণের অধীনে সামরিক কর্মজীবন বেছে নিলেন। উইন্সর ক্যাসেলের যে জর্জ চ্যাপেলে হ্যারি মেগনের পরিণয় ঘটতে যাচ্ছে, সেখানেই বিবাহ হয়েছিল ইতিহাসের আর এক বিতর্কিত সিংহাসনত্যাগী সম্রাট ৮ম এডওয়ার্ডের। আমার বালিকা বয়সে নানার কাছ থেকে শোনা শত কাহিনীর সঙ্গে তিনিও ছিলেন। ওয়ালিয়া সিম্পসন নামে দু’দুবার বিবাহ বিচ্ছিন্ন আর এক মার্কিনী নারীকে বিবাহ করার জন্য ত্যাগ করেছিলেন রাজসিংহাসন। ১৯৩৬ সালের প্রথম দিকে সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড পিতার মৃত্যুতে রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিবাহ প্রস্তাব সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে বলে পার্লামেন্টে এটার বিরোধিতা করে। পার্লামেন্ট ও চার্চ থেকে সেই বিয়ের বিরোধিতা করে বলা হলো একজন বাস্তুচ্যুত মহিলা যার রয়েছে দু’দুজন জীবিত প্রাক্তন স্বামী, এ রকম একজন নারীর সঙ্গে সম্রাটের বিবাহ রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ক’বছর আগে উইনসোর ক্যাসেলে বেড়াতে গিয়ে দেখা হলো সেন্ট জর্জের ভেতর বহু রাজরাজড়ার সমাধির মধ্যে রয়েছে অষ্টম জর্জ এবং তার স্ত্রীর সমাধি। হ্যারি এবং মেগানের এনগেজমেন্টের পর পরই বিবাহের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯ মে স্থান উইনসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেল। পিতা চার্লসের দ্বিতীয় বিবাহটি হয়েছিল এখানেই। রাজপ্রাসাদ থেকে ক্লিয়ারিং হাউসের একটি স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে, হার ম্যাজেস্টি কুইন চ্যাপেলে বিবাহের স্থানটি অনুমোদন করেছেন। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘দ্য রয়্যাল ফ্যামিলি’ এই বিবাহের ব্যয়ভার বহন করবে। মেগান মার্কল রাজবধূ হবার পর তার স্থায়ী নিবাস হবে কেনসিংটন প্যালেস। কেনসিংটন প্যালেস হলো লন্ডনে অবস্থিত রয়াল বরো কেনসিংটন গার্ডেনের একটি ইংল্যান্ডের রাজকীয় আবাসস্থল। ১৭ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলির একটি বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে ডিউক ও ডাচেস অব কেমব্রিজ উইলিয়াম ও কেট, প্রিন্স হ্যারি অফিসিয়াল লন্ডন বাসস্থান, রাজকুমারী ইউজেনি, ডিউক ডাচেস অব দ্য গ্লসিস্টার, ডিউক এবং রানি কেন্টসহ রাজকীয় ব্যক্তি বর্গের লন্ডনের বাসস্থান। হ্যারির সঙ্গে বাগদানের পর থেকে মেগান এই প্রাসাদের একটি ছোট এ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করে গ্রহণ করছিলেন রয়্যাল এটিকেটসহ রাজকীয় শিক্ষা-দীক্ষা। প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে বিবাহের পর উপাধি ‘ডাচেস অব সাসেক্স।’ হ্যারির সঙ্গে বসবাস করবেন লন্ডনের কেনসিংটন প্রাসাদের নটিংহাম কটেজে। মজার কথা কেনসিংটন প্রাসাদের এই হার হাইনেস জীবনের প্রথম চাকরিতে ঢুকেছিলেন ‘কেনসিংটন স্যুপ কিচেন।’ নামে এক কর্মস্থলে। বলা হচ্ছে প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে বিবাহের পর ‘ডাচেস অব সাসেক্স’ উপাধি পাবেন। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখিকা
×