ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রস্ফুটিত মানস-কুসুম পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ১৮ মে ২০১৮

প্রস্ফুটিত মানস-কুসুম পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

যাপিত জীবনের নানাবিধ যাতনা এড়িয়ে ছোট কাগজের মতো মননশীল এবং সৃজনশীল অজননন্দিত চর্চাকে নিয়মিত ধরে রেখে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা চাট্টিখানি কথা নয় মোটেও। বিশেষত নিয়মিত বছরে তিনবার, দ্বি-ঋতুভিত্তিক, চতুর্মাসিকরূপে বহুবিধ নান্দনিক মাত্রা অঙ্গে ধারণ করে প্রকাশ হতে হতে দশ বছরের মাইলফলক সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করা একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞ অত্যন্ত নিপুণ ও নিখাঁদভাবে সম্পন্ন করেছে ‘অরণিকা’, যার সম্পাদক অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক। ‘অরণিকা’ দশকপূর্তি সংখ্যা প্রচ্ছদে নান্দনিক, কলেবরে স্বাস্থ্যবান এবং ছাপায় ঝকঝকে। অর্থাৎ দশকপূর্তি সংখ্যাটি বরাবরের নান্দনিকতা ও মুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে বিশেষভাবেই অনিন্দ্য হয়ে উঠেছে সর্বদিক বিবেচনায়। দু’হাজার ছয় সালে জন্ম নেওয়া ‘অরণি’ তার নাম বিভ্রাটে ভুগেছে নাম নিবন্ধনের সমিলতায়, যা পরবর্তীতে দু’হাজার আট সালে ‘অরণিকা’ নামে কুমিল্লা হতে আত্মপ্রকাশ করে একক নামের অধিকারী হয়ে। পরবর্তীতে যুক্ত ‘কা’ কোন ক্ষুদ্র অর্থে নয় বরং একক সত্তা প্রকাশক চিহ্ন হিসাবেই অনেকটা গহনার গায়ে কেয়ূর এর ভুষণ হয়ে লেগেছে। দশকপূর্তির বর্ধিত কলেবরের সংখ্যায় দুইভাগে সাত ও পাঁচটি করে মোট বারোটি প্রবন্ধ, ছয়টি গল্প, দুই দফায় পাঁচ-পাঁচ দশজন কবির বাইশটি কবিতা, দুটি আত্মজৈবনিক গদ্য, একটি মুক্তগদ্য ও দুটি গ্রন্থ আলোচনা স্থান পেয়েছে। অরণিকার মূল শক্তি তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ- এ কথা বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও কবি অধ্যাপক ড. মোঃ মনিরুজ্জামান ‘অরণিকার দশক-পূর্তি কথা’য় উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রবন্ধে ‘অরণিকা’র বিগত সকল সংখ্যার উপাদানগত অধ্যয়নের তথ্য-উপাত্ত তিনি সারণিবদ্ধ করে তুলে ধরেছেন যা গবেষণামূলক বলেই প্রতীয়মান। তুলনামূলকভাবে গল্পের প্রকাশ এতে কম বলে তিনি উপাত্তে তুলে এনেছেন এবং চিত্রকলা সম্পর্কিত আলোচনা বা লেখার অভাবও তিনি এতে লক্ষ্য করেছেন। দশ বছরে একটিমাত্র নাটিকা অতি অপ্রতুল বলেই তাঁর অতৃপ্তি বিবৃত হয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধে। প্রাবন্ধিক ড. মোঃ মনিরুজ্জামান অরণিকার জন্য সম্পাদক মহোদয়কে কারও অভিনন্দন জানাতে কার্পণ্য না ঘটার কথা প্রত্যয়ের সঙ্গেই ব্যক্ত করেছেন। প্রফেসর বিমল কান্তি দে লেভ্ তলস্তয়কে নিয়ে লেখা প্রবন্ধে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে চারটি মৌলিক বিভাজনে বিশিষ্ট করে দেখিয়েছেন যাতে উপন্যাস, গল্প, মতবাদ বা প্রবন্ধ এবং নীতিকথা বা শিশুতোষ রচনা- এই শিরোনাম তিনি ব্যবহার করেছেন। দশম বর্ষপূর্তির এক মূল্যবান প্রাপ্তি গবেষক মানবর্ধন পালের ‘মুক্তিযুদ্ধ : প্রতিবেশী কবিদের চোখে’ প্রবন্ধটি। এতে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, জর্জ হ্যারিসন, রবিশংকর, শক্তি, সুনীল, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, পূর্ণেন্দু পত্রীরা তাদের মহান অবদানের জন্য আলোচিত হয়েছেন। মোহাম্মদ জয়নুদ্দিনের ‘মোনাজাতউদ্দীনের নাট্যশিল্প’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত শ্রমসিদ্ধ এবং তথ্যসমৃদ্ধ। ‘বাংলাদেশের ছোটগল্প’ শীর্ষক প্রবন্ধে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার গবেষণার মনন দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন বাংলাদেশের ছোটগল্পের জগৎকে। ঝিনাইদহের মরমী কবি পাগলা কানাইকে নিয়ে বঙ্গ রাখালের প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে আধ্যাত্মবাদ যেখানে আমরা পাই : ‘আমার যে জমিন আবাদ হয় না ছয় বলদে কথা শোনে না দেহজমিন পতিত রইলো শস্য ফলে না।’ বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাসের মাকে নিয়ে লেখা আত্মজৈবনিক গদ্য ‘শুকতারা জলদাসী’, যাতে লেখক তাঁর মায়ের জীবনের পাশাপাশি নিজের জীবনের অনেক ঘটনার উপর আলোকপাত করেছেন। লেখক তাঁর পরবর্তী জন্মেও এই সরলা মায়ের গর্ভজাত সন্তানরূপে জন্ম নেওয়ার আকাক্সক্ষা গর্বিত চিত্তে ব্যক্ত করেছেন। ‘ফিরে দেখা: আমার একাত্তর’ শীর্ষক আত্মজৈবনিক গদ্যে লেখক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক চমৎকারভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনিশ্চিত দিনগুলোকে লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এতে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বেশ কয়েকটি দাপ্তরিক দস্তাবেজ প্রকাশ করেছেন যা মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাসের উপাদান বলেই বিবেচিত। মুক্তগদ্য ‘ভৌতিক’ এ লেখক শেখর রঞ্জন সাহা অত্যন্ত চমৎকারভাবে নটীবিনোদিনীর ভূত-বিশ্বাসকে তুলে এনেছেন লেখনীতে। ‘বাংলা সাহিত্যে হাজার বছরের প্রেম উপস্থাপনের ধারা’ প্রবন্ধে নবীন প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে বিগত কালের সাহিত্যিকের প্রেম বিষয়ক সৃজনশীলতাকে প্রস্ফুটিত করেছেন। ডাঃ উত্তম কুমার ঘোষ রচিত ‘বাংলা ভাষার ভূত-ভবিষ্যত’ প্রবন্ধে কলোনিয়াল হ্যাংওভার থেকে এখনও না বের হতে পারার আক্ষেপ ঝরে পড়েছে যৌক্তিকভাবে। ‘বারোজন নোবেল বিজয়ীর কবিতা ও কাব্যভাবনা’য় প্রাবন্ধিক আহমেদ কবির দারুণভাবে নোবেল বিজয়ীদের উপস্থাপন করেছেন। প্রফেসর জাহানারা খাতুন বিস্তৃত পরিসরে লোকজ উপাদানকে ধরে রেখেছেন ‘হবিগঞ্জের বারোমাসী গানে লোকায়ত অনুষঙ্গ’ প্রবন্ধে। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর রম্য গল্প ‘রামপুরাণ’, মাহি মুহাম্মদের ‘বারনারী’, রাজকুনার সিংহের ‘ছোবল’, সিরাজুল ইসলামের ‘অঙ্গার’, রফিকুজ্জামান রনির ‘গুমট ভাঙ্গা নদী’, মানিকরতন শর্মার ‘বাইসাইকেল’ গল্পগুলো বিশেষ সংখ্যার বিশেষ উপাদানের মতোই। দশম বর্ষপূর্তি সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন কবি মানজুরুর রহমান, ইকবাল করিম রিপন, মোঃ এহসানুল হাবিব, গোবিন্দ বিশ্বাস, রাশেদ মোশারফ, জলিল সরকার, খায়রুল আহসান মানিক, নাগর হান্নান, আমির হোসেন এবং সৌম্য সালেক। দুটি গ্রন্থের সার্থক আলোচনা হয়েছে যার একটি বঙ্গ রাখালের ‘মানবতাবাদী লালন (জীবন অন্বেষা)’ আর অন্যটি অন্যটি কবি রুহুল কাদেরের দ্বিতীয় কাব্য ‘দহনদ্রোহ’। প্রথমটি আলোচনা করেছেন ডাঃ মধুসূদন দাশ এবং দ্বিতীয়টি আলোচনা করেছেন পদ্মলোচন বড়ুয়া ‘স্বপ্নচারী লেখকের মাটির রাজ্যে অভিষেক’ শিরোনামে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদের একটি মূল্যবান চিঠি পত্রস্থ হয়েছে যা অরণিকার একটি বিশেষ সম্পদ বলে বিবেচিত। এতে মফস্বলের প্রকাশনা বলেই অরণিকা অনার্য ও তাচ্ছিল্যে উপেক্ষিত হবে এই ধারণাকে তিনি তীব্রভাবেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অরণিকার পূর্ব-সংখ্যাগুলোর সূচিপত্র ও সম্পাদকীয় দশকপূর্তির বিশেষ পাওয়া বলেই ধরে নেওয়া যায়। হাতে নেওয়ার পরে অপার্থিব আনন্দে মন ভরে যায় যখন দশকপূর্তি সংখ্যাটি ঝলমলিয়ে ওঠে অমর্ত্য আলোয়। যে কোন মাইলফলক একটি অনন্য অর্জন। ছোট কাগজ অরণিকার দশকপূর্তির সংখ্যাটি নান্দনিক, সৃজনঋদ্ধিসম্পন্ন প্রকাশনা যার আবেদন কখনো শেষ হবে না বলেই প্রত্যয়ন করা যায়।
×