ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থানের গতিপ্রকৃতি

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৮ মে ২০১৮

কর্মসংস্থানের গতিপ্রকৃতি

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সররকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক ২০১৭-১৮ সালে ঘোষিত বাজেটে জিডিপি এর প্রবৃদ্ধির হার টার্গেট করা হয়ে ছিল ৭.৫% এবং সরকারী ভাষ্যমতে এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৭.২%এর বেশি। আবার মাথা পিছু আয় গত বছরের তুলনায় বেড়ে বর্তমানে ১৭৫২ মার্কন ডলারে উন্নতি হয়েছে। মূল্যস্ফৃতি ৬% এর নিচে রয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৮০০ বিলিয়ন মাকিন ডলার। এই বিশাল রিজার্ভ দেশের কর্মসংস্থান, উৎপাদন কিংবা প্রবৃদ্ধিতে কিভাবে কতটুকু কাজে লাগছে বা লাগানো হচ্ছে তা নিয়ে তেমন আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। তবে অর্থনীতিবিদগণ বলছেনÑ প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয় এই চারটি অর্থনৈতিক চলকের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন বর্তমানে এই চারটি চলকের মধ্যে তেমন কোন সমন্বয় পরিলক্ষিত নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সেই হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস বলছে দেশে যে হারে জিডিপি বাড়ছে সেই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বর্তমানে বছরে গড়ে ১১ লাখ অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে অথচ উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের গড়ে ১৬ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)এর বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তথ্য মতে দেশে ১০.৯১ কোটি ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ রয়েছে যার মধ্যে বেকার মানুষের সংখ্যা ২৬.৮০ লাখ। আবার উচ্চ শিক্ষিত বেকারের হার মোট বেকারত্বের ১১.২ শতাংশ এবং ফি বছরে ২০ লাখ মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে অথচ সে পরিমাণে কর্ম সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা আছে এমন লোকদের কর্মহীনতার হার ২.৭ শতাংশ অর্থাৎ যিনি যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছেন তার বেকারত্বের সম্ভাবনা তত বেশি সৃষ্টি হচ্ছে। আবার আঞ্চলিক বৈষ্যম্য বেড়েছে, শহরের চেয়ে গ্রামে বসবাসকারী লোকদের আয় কমছে ও নারীদের আয় কমছে পুরুষের তুলনায়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন, কর্মসংস্থান যা হচ্ছে প্রায় সবটুকুর দাবিদার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত যার পুরোটা ধরেই রয়েছে সরকারী বিনিয়োগের প্রভাব যেখানে সমাজের সাধারণ মানুষ তথা দুর্বল শ্রেণীর খুব একটা সুফলের অংশীদার হবে না। আবার প্রবৃদ্ধির হিসাবে জিডিপি এর অনুপাতে বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়েনি অর্থ্যাৎ মুদ্রানীতির উল্লিখিত ব্যাংক কর্তৃক বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১৬.৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৮.৫ শতাংশ হওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিনিয়োগ বাড়ল না অথচ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অতিক্রম হলো তা হলে টাকা গেল কোথায়? প্রশ্ন এই বিনিয়োগের মান নিয়ে যা অনেক ক্ষেত্রে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বর্তমানে আর্থিক বছরের সংশোধীটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে এডিপি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং বিগত নয় মাসে (জুলাই মার্চ) ৪৫ শতাংশ অর্থ ব্যয়িত হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে। বছরের বাকি তিন মাসের মধ্যে আশা করা যায় ৫৫ শতাংশ অর্থ ব্যয়িত হবে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে। এই বিনিয়োগ কতটুকু কর্মসংস্থান সহায়ক হবে তা সরকারী সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলে দেবে সময়ান্তে। তবে অভিজ্ঞতা বলছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ নুতন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অধিত ভূমিকা রাখে তুলনামূলকভাবে সরকারী খাতের চেয়ে এবং দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তাদেরকে যদি গড়ে তুলা যায় তা হলে অভীষ্ট প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। তবে জমির স্বল্পতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা, বিদ্যুত তথা জ্বালানির সহজ লভ্যতার অভাব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়েছে। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক শ্রেণী ১৮-৩৫ বছরের সীমাবদ্ধ তাদের যদি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ মাধ্যমে উদ্যোক্তা উন্নয়নের উদ্বুদ্ধ করা যায় তা হলে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও আয়ে দেশ সমৃদ্ধ হবে যা জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক। কিন্তু সমস্যাটা হলো আর্থিক খাতের ব্যাংকিং এর অংশ নিয়ে এবং তারল্য সঙ্কট, খেলাপী ঋণের সঙ্কট, ব্যাংকের গ্রাহকের তিক্ত সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ তথা কর্মসৃষ্টি কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে যার সঙ্গে প্রবৃদ্ধি সর্ম্পক যুক্ত। তারল্য সঙ্কটের প্রধান কারণ খেলাপী ঋণ ও এডিআর এ সামঞ্ছস্যতা বজায় না রাখা অর্থাৎ ডিপজিটের চেয়ে অগ্রিম বেশি যা বিধি মোতাবেক মোট ডিপজিটের শতকরা ৮৫ ভাগ পর্যন্ত অগ্রিম দেয়ার দাফতরিক নির্দেশনা রয়েছে। বহু ব্যাংক সেই সীমা অতিক্রম করে বেশি বিনিয়োগ করছে যার প্রমাণ বেসরকারী খাতে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ (আইবিবিএল) যাদের বিনিয়োগ এখন প্রতিষ্ঠান নীতিনির্ধারকরা বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় খবর এসেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৪টি ব্যাংকের (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী) মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২৮,৯৫৬ কোটি টাকা এবং সার্বিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা যা মোট বিনিয়োগকৃত ঋণের শতকরা ১২ ভাগ যাকে অনেক মহাবিপদ সংকেত বলে আখ্যায়িত করছে। এই ঋণখেলাপী ঋণ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে, মূলধন ঘাটতিতে সহায়তা করে এবং ব্যাংকের মুনাফা কমিয়ে দেয় তথা গ্রাহকদের আস্থা হারায়। অতিসম্প্রতি এই তারল্য সঙ্কটের মোকাবেলায় বেসরকারী ব্যাংকের সংগঠন অর্থমন্ত্রীর কাছে দুটি দাবি উত্থাপন করেন (১) বর্তমানে প্রচলিত সি.আর.আর ৩ শতাংশ কমিয়ে আনা; (২) সরকারী ফান্ডের অর্ধেক বেসরকারী ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বর্তমানে প্রচলিত সি.আর.আর ৬.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে কোন হিসাব পত্র ছাড়াই এবং এতে করে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে এসেছে তারল্য সঙ্কটের ঘাটতি মোকাবেলায় যা ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়তি শক্তি জোগাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন এই সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাত তথা অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত কারণ এটি নির্বাচনী বছর বিধায় বিনিয়োগে ব্যাংকারদের আরও সতর্ক থাকতে বলেছেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। অর্থনীতিতে এই বাড়তি তারল্য যদি অনুৎপাদন খাতে ব্যয়িত হয় তবে দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটবে এবং নির্বাচন ব্যয় মেটাতে বাইরে টাকা পাচার হয়ে যাওয়া একটা সম্ভাবনা রয়েই যাবে যা অতীতে হয়েছে। কাজেই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও বেশি হিসাব নিকাশের বিষয় বয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যদিও বিগত ঘোষিত মূদ্রানীতির (জানুয়ারি-জুন) অনেক শর্তই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানছে না। ফলে বিনিয়োগ না বেড়ে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অতিক্রম হয়ে গেল যা অর্থনীতির জন্য সুখবর নয়। সামনে বাজেট আসছে যা নিয়ে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তাদের উৎকণ্ঠার শেষ নেই যার সঙ্গে বিনিয়োগের বিষয়টা জড়িত বিশেষত উচ্চসুদে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ব্যাংক মালিকদের বলছেন ব্যাংকের সুদের হার এক ডিজিটে নিয়ে আসতে কিন্তু বিষয়টি অতি সহজ হবে না। কারণ বর্তমানে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার বাড়ানোর ফলে নিয়মানুসারে ৫ ভাগ স্প্রেড রেখে সুদের হার নির্ধারণের বিধান রয়েছে যা কমাতে হলে সঞ্চয়ে সুদের হার কমাতে হবে যার প্রভাব পড়বে ব্যাংকের মোট ডিপোজিটের ওপর। কাজেই একদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে যার সঙ্গে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে। এখন বেসরকারী বিনিয়োগের ব্যাপারে সুদের হার একটি বিষয় তবে এটাই শেষ নয়। ব্যাংক যদি সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ লোন উদ্যোক্তাদের হাতে তুলে দিতে পারে তবে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি একই সঙ্গে ত্বরান্বিত হবে এবং দেশ উন্নতির দিকে যাবে। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা এবং সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি
×