ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোকেয়া প্রাচী

তাঁর প্রত্যাবর্তন, জাতির মুক্তি

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৮ মে ২০১৮

তাঁর প্রত্যাবর্তন, জাতির মুক্তি

১৬ কোটি মানুষের মিছিলে একজনই নেতা আমাদের। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। অদম্য সাহস বুকে নিয়ে সব বাধা পেছনে ফেলে এগিয়ে যান তিনি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এক অপার নির্ভরতা ও মুক্তির নাম শেখ হাসিনা। বিশ্বজুড়ে যার স্বীকৃতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বলতে আমরা মূলত বুঝে থাকি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করার কথা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসার ঘটনা ছিল বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের আরেক আশীর্বাদ এবং বিজয়ের পূর্ণতা। কিন্তু ’৭৫-এ মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশী-বিদেশী শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের ধারায় তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দিকপাল হারা জাতির মুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও বহু বছর। পিতা-মাতা হারিয়ে, পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে শত শোকের ভেতরও থেকে ফুল হয়ে ফুটেছিলেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হলে ওই বছরেরই ১৭ মে তারিখে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সে হিসাবে ১৭ মে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ওই দিনটি ছিল রবিবার। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে লাখো জনতার ঢল নামে। সেদিনের গগনবিদারী মেঘ গর্জন, ঝাঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বদলা নেয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল, আর অবিরাম মুষলধারে ভারি-বর্ষণে যেন ধুয়ে-মুছে যাচ্ছিল বাংলার মাটিতে পিতৃ হত্যার জমাট বাঁধা পাপ আর কলঙ্কের চিহ্ন। শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সব সদস্যের রক্তে ভেজা বাংলার মাটি স্পর্শ করে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এই সময় উন্মত্ত জনতা সামরিক শাসক জিয়ার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। ঝড়-বৃষ্টির আকাশ কাঁপিয়ে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকের চার পাশে স্লোগান উঠে- পিতৃ হত্যার বদলা নিতে-লক্ষ ভাই বেঁচে আছে; শেখ হাসিনার ভয় নাই- রাজপথ ছাড়ি নাই তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেদিন কুর্মিটোলা থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত। লাখ লাখ লোকের সংবর্ধনায় তিনি জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ ১৯৮১ সালের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি এতটাই বিভ্রান্ত এবং পথহারা ছিল, আওয়ামী লীগ তো অনেকটাই নেতৃত্বশূন্যই ছিল। তার ওপর এই দলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা এতোটাই তীব্র ছিল যে, এসবকে প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে নতুনভাবে দাঁড়ানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এর ওপর শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমান নিহত হলে পর্দার অন্তরালে এসব কিসের দ্বন্দ্ব বা কিসের আলামত-তাও বোঝা যাচ্ছিল না। তেমন একটি ঘোলাটে সামরিক শক্তি নতুনভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠার সময়ে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলেন, নতুন করে সবকিছু গোছাতে লাগলেন, অভিজ্ঞতার অবস্থানটিও তখন তার ছিল যৎসামান্য, দলের রণনীতি, রণকৌশল নির্ধারণ, দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামরিক শাসন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালকে ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন পর্যন্ত বেশ জটিল এবং দুরূহ কাজ ছিল। অধিকন্তু পিতার মতো তবে বরাবর তিনিও ছিলেন ঘাতকের ষড়যন্ত্রের টার্গেটে। তাকে হত্যা করার যড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তখন থেকেই। একবার নয়, দুইবার নয়, শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। দলকে টেনে নিয়েছে টানা ৩৫ বছর। এই ৩৫ বছরে দুইবার দলের নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা বলেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রথমবার ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয় এবং সব শেষ ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগে। কিন্তু দুইবারই কাউন্সিলররা জানিয়ে দিয়েছেন তারা চান না তা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর আবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে বিএনপিকে চাপ দিয়ে তাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন কেবল একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নয়, জাতীয় রাজনীতির হাল ধরতে, সেনাশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে। এর আগে বিদেশে অবস্থানকালে তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। দেশের মাটিতে পা রাখার দিন থেকেই শুরু হয় তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামী জীবন, তিন দশকের অধিক সময় ধরে যা বিস্তৃৃত। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এই দিনটির তাৎপর্য তাই ভুলবার মতো নয়। ভেতরে নরম কোমল এক মাতৃস্বভাবের মমতাময়ী নারী তিনি। শত কাজের ভিড়েও যার ছেলের জন্য রাঁধতে ইচ্ছে করে, নাতি নাতনিদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্টে নেমে যান, সমুদ্রে গেলে সমস্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে সমুদ্র জলে পা ভেজাতে ইচ্ছে করে যার, তিনিই আবার শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করছেন। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস আর সকল দেশী-বিদেশী চক্রান্তকে নস্যাত করে দিয়ে আপন কৌশলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধির শিখরে। নারী নেতৃত্বের এমন দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা ছাড়া আর কে পেরেছে পৃথিবীতে? বাংলার মাটিতে বারবার ফিরে আসুক এমন নারী। জন্ম নিক শত সহস্র শেখ হাসিনা। লেখক : অভিনেত্রী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ
×