ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের নির্দেশনায় তোয়াক্কা নেই চালকের, যেখানে খুশি সেখানেই থামে

রমজানে মারাত্মক যানজটের আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৮ মে ২০১৮

রমজানে মারাত্মক যানজটের আশঙ্কা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড় পার হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের দিকে যেতে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনের রাস্তায় সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘এখানে বাস থামানো নিষেধ’। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা। তাতে কি! গুলিস্তান কিংবা মতিঝিল থেকে আসা সব বাস এখানেই থামছে। তোলা হচ্ছে যাত্রী। ফলে পরিবহন জটলা লেগেই আছে। গুরুত্বপূর্ণ মোড় কাকরাইলেও এ চিত্র প্রতিদিনের। মহাখালী বাস টার্মিনালের উভয়পাশে সাইনবোর্ডে ‘বাস থামানো নিষেধ’ লেখা রয়েছে। সেখানেও কারণে-অকারণে বাস থামে। মালিবাগ রেলগেট এলাকার চিত্রও একই রকমের। এই পয়েন্টে বাসের জটলার কারণে আবুল হোটেল থেকে মালিবাগ রেলগেট আসতে সময় লাগে অন্তত এক ঘণ্টা! নগরীর অন্তত শতাধিক পয়েন্ট ঘুরে এ ধরনের চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বাস্তবতা হলো, যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগের সাইনবোর্ডের নির্দেশনা কার্যত অকার্যকর। পরিবহন চালকের অনেকেই জানেন না, থামা-না থামার নির্দেশনার কথা। পুলিশও এ ব্যাপারে তৎপর নয়। খোদ মতিঝিলেই মানার চিত্র চোখে পড়েনি। বাস স্টপেজে বাস থামানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়নি চালকের মধ্যে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, যানজট নিরসনে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ এই পদক্ষেপ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর যৌক্তিকতা কতটুকু! পুলিশ বলছে, যান চালকদের নির্দেশনা মানাতে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তনে সময় লাগবে। চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড থাকার কথা জানেনই না অনেকে। আবার কারো কারো মত, অন্যদের মতো তিনিও বাস থামাচ্ছেন। অর্থাৎ অনিয়মই তাদের কাছে নিয়মে রূপ নিয়েছে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তায় অনিয়মের কারণেই দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে নগরীর যানজট পরিস্থিতি। রাস্তায় নামলে কখন গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। নিত্য দুর্ভোগ রাস্তায় রাস্তায়। অপেক্ষা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় স্বল্পমেয়াদী পরামর্শগুলো কার্যকর করা গেলে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলোও যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের এক সভায় রমজানে রাজধানীতে যানজট সহনীয় রাখতে মহানগর পুলিশের সহযোগিতা কামনা করা হয়। এ সময় পরিবহন নেতারা বলেন, প্রতিবছর রমজানে রাজধানীতে যানজটের মাত্রা বাড়ে। ঈদ কেন্দ্র করে বাড়তি মানুষের চাপের কারণে এই পরিস্থিতি দেখা দেয়। ফলে গণপরিবহন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না। ট্রিপ কমে যাওয়ায় আয় কমে। পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিয়ে আমরা চিন্তিত। কোন অবস্থাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তাই আমরা এবার সরাসরি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছি। তিনি বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত বলছে, এক দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। যানজটে এখন ঘণ্টায় সর্বোচ্চ পাঁচ কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করা যায়। এই অবস্থার উন্নতি না হলে ২০২৫ সালে যানবাহনের গতি ঘণ্টায় চার কিলোমিটারে কমে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে রাজধানীতে নিবন্ধিত পরিবহনের সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। অপরিকল্পিত নিবন্ধন চলছেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অযান্ত্রিক আরও অন্তত ১০ লাখ যান। ঢাকার বাইরে থেকে অন্তত লক্ষাধিক যানবাহন রাজধানীতে প্রবেশ করছে প্রতিদিন। চলমান বাস্তবতায় পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকায় যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে। যানজট ৯ ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। গবেষণায় বলা হচ্ছে, যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও যে বাড়বে, তা বলাবাহুল্য। সঙ্কট সমাধানে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে দ্রুত গতির ট্রেন সার্ভিস চালু ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেয়ার মতামত আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যানজটে রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। যানবাহনের সংখ্যা যদি বাড়তে থাকে তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। মানুষের হাঁটার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বলে মনে করা হয়। এ তথ্য বিশ্বব্যাংকের। আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির মতে, যানজটের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও যে বাড়বে, তা বলা বাহুল্য। যানজটের কারণে রাজধানীতে যান প্রবেশ করতে না পারায় প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে ২ হাজার কোটি টাকা আয় নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া সকাল আটটা থেকে রাত আটটা ১২ ঘণ্টায় রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনকে যানজটের কারণে প্রায় সাড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামছে প্রায় ২০০ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন। আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে ॥ ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ যাত্রা (ট্রিপ) হয়। একজন মানুষ কোন একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে যানজটে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে যানজটের কারণে। এ থেকে বলা যায়, গড়ে আর্থিক ক্ষতি বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গবর্নেন্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের সংখ্যা যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোন উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। ২০১৭ সালে জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়, গত ১০ বছরে ঢাকার যান চলাচলের গড়গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে মাত্র সাত কিলোমিটারে এসেছে। ওই হিসাবে প্রতিদিন ঢাকায় নষ্ট হতো ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। সেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে এক বছরে। এআরআইএর পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রাজধানীতে যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যানজটের পেছনের কারণ ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতেগোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোঁড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাথের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতার সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া অন্যতম। তা ছাড়া দুই শতাধিক কোম্পানির অধীনে শহরের বাস সেবা পরিচালিত হওয়ার ফলে যাত্রী ওঠানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাও যানজটের অন্যতম কারণ। এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সব পেশার, সব বয়সী মানুষ যানজটের ফলে ভুক্তভোগী। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। যানজট নিরসন একক কোন সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যানজট সমাধানে ট্রাফিক আইন মেনে চলা, ভিজিলেন্স টিম গঠন, আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে জরিমানা করতে হবে। ইন্টার সেকশনের কাছে স্টপেজ বন্ধ করতে হবে। অবৈধ পার্কিং, ফুটপাথ ও রাস্তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে দখলমুক্ত করা সম্ভব হলে ৩০ ভাগ যানজট কমবে। যানজট নিরসনে পুলিশের প্রতিবেদন ॥ যানজট নিরসনে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। যেখানে রাজধানীতে যানজটের ১৯ কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে ২১৯ বাস স্টপেজ এবং বিআরটিসি কর্তৃক অনুমোদিত ২০৮ বাস রুট রয়েছে। বিআরটিসি ও বেসরকারী মিলিয়ে প্রতিদিন ১২ হাজার বাস/মিনিবাস রুটগুলোয় যাত্রী পরিবহন করে থাকে। বাস স্টপেজে বাস না থামিয়ে মূল রাস্তার ওপর থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। এ ছাড়া আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো নগরীর অভ্যন্তরে হওয়ার কারণে যানজট সৃষ্টি হয়।
×