ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভুয়া বিয়ে করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে নারী প্রতারক

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৮ মে ২০১৮

ভুয়া বিয়ে করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে নারী প্রতারক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ভুয়া বিয়ে করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া এক সুন্দরী নারী প্রতারক চক্রের সন্ধান মিলেছে। অহিদা বেগম কবিতা নামের এই নারী গড়ে তুলেছে বিশাল এক প্রতারক চক্র। চক্রে ভুয়া শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকা, আত্মীয়স্বজন, খালা-খালু ও বিয়ে পড়ানো কাজী থেকে শুরু করে সব ধরনের আত্মীয় স্বজন রয়েছে। বিয়ে করার পর কারও বোঝার উপায় নেই, তার স্ত্রীর পক্ষের সব আত্মীয়স্বজনই ভুয়া। কবিতা বিয়ের পর ছয় থেকে সাত মাস পর্যন্ত সংসার করে। ওই সময়ের মধ্যেই টার্গেটকৃত ব্যক্তির মন জয় করে নগদ টাকা, দামী দামী আসবাবপত্র, স্বর্ণালঙ্কার, জমি, ফ্ল্যাট হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। চক্রটির হাতে সাতজনের প্রতারিত হওয়ার তথ্য মিলেছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে কতজন প্রতারিত হয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য মেলেনি। পাঁচ বছরে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার অর্থ সম্পদ। চক্রটির টার্গেট চল্লিশোর্ধ পুরুষ। একটি প্রতারণার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআইয়ের প্রধান পুলিশের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, অনেক প্রতারণার মামলা তারা তদন্ত করেছেন, কিন্ত এ ধরনের অভিনব প্রতারণার ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো। এমন অভিনব প্রতারণার তথ্য পাওয়ার পর প্রতারণার মামলা আরও গভীরভাবে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। আসামিরা পলাতক। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, অহিদা বেগম কবিতা (৩২) নামের ওই নারী সুন্দরী মূলত প্রতারক। তার পিতা মৃত সাবদার আলী। মায়ের নাম জাহেদা বেগম। বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানাধীন আমড়াতলী গ্রামে। ভাগ্য ফেরানোর সন্ধানে ঢাকায় আসে। ভাগ্যের পরিবর্তনও করেছে। তবে অসৎ পথে। কবিতা ঢাকা বিশাল একটি চক্র গড়ে তুলেছে। সেই চক্রে রয়েছে কবিতার কথিত পিতা-মাতা, ভাই-বোন, খালা-খালুসহ একজন মানুষের যত ধরনের আত্মীয় থাকতে পারে, তা সবই রয়েছে। তবে সবাই ভুয়া। তারা নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে বিয়ের পর সন্তান ও স্বামী রেখে স্ত্রী চলে গেছেন বা স্ত্রীর ডিভোর্স হয়ে গেছে, এমন চল্লিশোর্ধ পুরুষদের সর্ম্পকে তথ্য সংগ্রহ করে। তারপর সেই পুরুষকে বিয়ে করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল হিসেবে প্রথমে ওই পুরুষের পাশের বাসায় ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে সর্ম্পক করে বিয়ের পর প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এমন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কবিতা মুগদার বাসিন্দা মোঃ আকরাম হোসেন চৌধুরী ওরফে লিটনকে (৬৪) টার্গেট করে। লিটনের আয়শা (২০), আছিয়া (১৮) ও মাহবুবা (১৩) নামে তিনটি কন্যাসন্তান আছে। ২০০৮ সালে লিটনের সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা না হওয়ায় তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। লিটনকে টার্গেট করে প্রতারক চক্রের সদস্য বেলায়েত হোসেন কাজল ওরফে মোহাম্মদ কাজল ওরফে মোঃ কাজল মিঝি (৪৫) ও তার কথিত স্ত্রী শিলা বেগম ওরফে ফাহিমা বেগম (৩৩) লিটনের পাশাপাশি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। চক্রেরই এই দম্পতি সদস্যের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন থানাধীন বড় মানিয়া গ্রামে। এরা লিটনের ওপর নজর রাখতে থাকে। তার সঙ্গে সর্ম্পক গড়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এ দিকে মূল প্রতারক কবিতাও লিটনের বাসার পাশে ১/২১ নম্বর দক্ষিণ মুগদা কমিউনিটি সেন্টারের হুমায়ুন নামে এক ব্যক্তির বাসা ভাড়া নিয়ে কথিত স্বামী নিয়ে বসবাস করতে থাকে। কবিতাও মাঝে মধ্যেই লিটনের সঙ্গে অনেকটা নাটকীয়তা করে পাশাপাশি বসবাসের সুবাদে যাতে মুখ চেনা থাকে এমন ভাব করে। কবিতা পরিকল্পিতভাবে লিটনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে সামনে পড়ে যায় বলে লিটনকে বুঝানোর চেষ্টা করে। এতে করে দু’জনের মধ্যে পাশাপাশি বসবাসের সুবাদে সামান্য চেনা পরিচয় ঘটে। এর কিছু দিন পরই কবিতার চলতি পথেই লিটনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে, এমনটা ভাব করে। লিটনকে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করে। লিটনও মুখচেনার পরিচয়ের সূত্রধরে কবিতাকে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করেন। কবিতা কষ্ট ভরা মন নিয়ে বলেন, আর কেমন থাকি ভাই! ভাল নেই। কারণ জানতে চাইতেই কবিতা জানায়, তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে। সে মানবেতর জীবন যাপন করছে। লিটনের সঙ্গে মাঝে মধ্যে প্রয়োজন হলে দেখা করবেন, এমন কথার ফাঁকে তার মোবাইল নম্বর চেয়ে নেয়। সেইসঙ্গে নিজের মোবাইল নম্বরও দেয়। কয়েক দিন দু’জনের মধ্যে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রতারক চক্রের সদস্য শিলা বেগম লিটনের সঙ্গে দেখা করেন। শিলা লিটনের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে জানায়, কবিতা নতুন করে বিয়ে করতে চায়। সে ক্ষেত্রে লিটনকে তার ভাল লেগেছে বলে জানায়। লিটন রাজি থাকলে কবিতা তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে। পরবর্তীতে যথারীতি বিয়ে হয়ে যায়। কবিতা লিটনের সংসার করতে থাকে। মেয়েদের খুবই আদর যতœ করতে থাকে। এতে করে লিটন খুবই সন্তোষ্ট হন কবিতার ওপর। কবিতা খুশি করে লিটনের কাছ থেকে বাড়ির জন্য দামী ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাবপত্র, ভাইকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ছাড়াও নানা উছিলায় টাকা হাতিয়ে নিতে থাকে। এভাবে ছয় মাস টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর লিটন সন্দেহ করতে থাকলে কবিতা আর তার সঙ্গে সংসার করবে বলে জানায়। সর্বশেষ কবিতা স্বামীর কাছ থেকে ঈদের বাজার করার কথা বলে নগদ প্রায় সোয়া লাখ টাকা নেয়। সর্বশেষ লিটন তার অসুস্থ মাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গেলে কবিতা তার চক্রের সদস্যদের নিয়ে বাড়িতে থাকা সব স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। সব মিলিয়ে কবিতা শুধু নগদ টাকা স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেয় প্রায় ১৬ লাখ টাকার। লিটন গ্রাম থেকে বাড়িতে এসে দেখে ঘরে কোন টাকা পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার নেই। ঘরে স্ত্রীও নেই। এরপর স্ত্রীর দেয়া ঠিকানা মোতাবেক খোঁজ করতে গিয়ে তার চক্ষু চরকগাছ। সব ঠিকানা ভুয়া। এমনকি এতদিন কবিতার পিতামাতাসহ যত আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন, তাদের কারও কোন খোঁজ খবর নেই। কারও কোন হদিস নেই। এমনকি বিয়ে করানো কাজী অফিসে গিয়ে দেখেন, সে নামে কোন কাজীই নেই। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর পরিদর্শক মোহাম্মদ শামীম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু লিটন নয়, তার মতো ইসমাইল (৬০), নিরঞ্জন দাশ (৪২), আনোয়ার হোসেনসহ (৫০) অন্তত সাতজন প্রতারিত হয়েছেন। সর্বশেষ মাসুদ রানা (৫৬) নামে একজন কবিতার কাছে প্রতারিত হন। মাসুদ রানার কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তার সঙ্গে মাত্র কয়েক মাস সংসার করেছে কবিতা। মূলত কবিতা একজন পেশাদার প্রতারক। সে নিজেই চক্রটির নেতৃত্ব দেয়।
×