ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভোজ্যতেল চিনি ছোলা ডাল খেজুর পেঁয়াজের মজুদ পর্যাপ্ত

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৮ মে ২০১৮

 ভোজ্যতেল চিনি ছোলা ডাল খেজুর পেঁয়াজের মজুদ পর্যাপ্ত

এম শাহজাহান ॥ রমজানের চাহিদা মেটাতে ভোজ্যতেল চিনি ছোলা ডাল খেজুর ও পেঁয়াজের মতো ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারী পর্যায়ে আমদানিকৃত এসব পণ্য এবার ন্যায্যমূল্যে বিক্রির পালা। সরকারীভাবে নির্দেশনা সেভাবেই রয়েছে। কিন্তু নির্দেশনা অমান্য করে কোন ব্যবসায়ী কৃত্রিম সঙ্কট ও কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির অপচেষ্টা গ্রহণ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বাজার মনিটরিং টিম এখন মাঠে রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বাজার তদারকি করছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারী অন্যান্য সংস্থা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এবার ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় মজুদ বাড়ানো হয়েছে। পণ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণ সুবিধা, দ্রুত এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি, মাল ছাড় করণে বন্দরে সহযোগিতা এবং কোন কোন পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমে যাওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এবার খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে কম। সরকারী সব সুবিধা গ্রহণ করে এসব পণ্য আমদানি হলেও ইতোমধ্যে পেঁয়াজ ও খেজুরসহ দু’একটি পণ্যের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। সরকারী সংস্থাগুলো এসব বিষয়ে তদারকি বাড়িয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানা করা হবে ব্যবসায়ীদের। পুরো রমজান মাস জুড়ে সক্রিয় থাকবে সরকারী সংস্থাগুলো। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবি বাজারে ভর্তুকি দিয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটি পুরো রমজান মাস জুড়ে বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, এবার ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তাই কোন পণ্যের দাম বাড়ানো হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ পণ্য আমদানি হয়েছে। দেশে কোন ভোগ্যপণ্যের সঙ্কট নেই। শুধু তাই নয় বাজার মনিটরের জন্য মাঠে নামানো টিমে দেশের চারটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ছাড়াও র‌্যাব, পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে। অবৈধ মজুদের সন্ধান পেলে মজুদকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি জানিয়েছেন, প্রতিবছরই বাজার পরিস্থিতি জানতে ও তদারকিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা যৌথভাবে কাজ করে। এ বছরও করবে। যে কোন অজুহাতে নিত্যপণ্যের বাজার যাতে অস্থির না হয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চাহিদার তুলনায় দেশে সব ধরনের পণ্যের মজুদ সন্তোষজনক। দেশে কোন পণ্যের ঘাটতি নাই। সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, ব্যবসায়ী নেতা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ওই বৈঠকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, গত ২০০৭ সাল থেকে ঢাকা শহরের বাজার তদারকির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি মনিটরিং টিম রয়েছে। একজন উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা এবং পুলিশ ও র‌্যাবের সমন্বয়ে এ টিম গঠিত। তারা নিয়মিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকেন। এবার রমজানে বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখা, পণ্যের অস্বাভাবিক মজুদ ঠেকানোসহ সরবরাহ ঠিক রাখতে এই ১৪ মনিটরিং টিমকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশিন ও ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। গত ২০১১ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ও সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করবে প্রতিটি তদারকি দল। সংশ্লিষ্ট তদারকি দল বাজার কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে মাঝে মধ্যে দোকানিদের সঙ্গে আলোচনা করবে এবং ওই বাজারে পণ্যের সরবরাহ, মজুদ ও মূল্য তদারকির মাধ্যমে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এদিকে, এ বছর টিসিবি রাজধানীসহ সারাদেশে ছোলা ৭০ টাকা কেজি দরে, প্রতিকেজি মসুর ডাল (মাঝারি সাইজের) ৫৫ টাকা, খেজুর ১২০ টাকা, প্রতিকেজি চিনি ৫৫ টাকা এবং ভোজ্যতেল ৮৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছে। ঢাকায় ৩২টিসহ সারাদেশে ১৮৪টি ট্রাকে এসব পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে। স্বল্প আয়ের ভোক্তারা বাজার মূল্যের চেয়ে টিসিবির পণ্য কম দামে কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। ছয় পণ্যের মজুদ পরিস্থিতি ॥ চাহিদার তুলনায় দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সারা বছর এ পণ্যটির চাহিদা ২৪ লাখ টন। এ বছর উৎপাদন ও আমদানি ভাল হয়েছে। এছাড়া পেঁয়াজের প্রধান উৎস ভারতেও পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমদানি ভাল, তাই দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৫৩ লাখ টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, এই সময়ে আমদানি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৭ লাখ টন। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে প্রায় ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। আর রমজান মাসে ২ থেকে আড়াই লাখ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া ইফতারির প্রধান উপকরণ এই ছোলা। এ কারণে রোজা আসলে ছোলার দাম বাড়ে। তবে এ বছর শবে-বরাতের পরও এ পণ্যটির দাম বাড়েনি। কারণ চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ছোলা দেশে মজুদ রয়েছে। সারা বছর দেশে ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই চাহিদা থাকে ৪০-৫০ হাজার টনের। এ পণ্য দেশেও উৎপাদন হয়। এ বছর সাড়ে ৫ হাজার টন দেশে উৎপাদন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার টন। চাহিদার দ্বিগুণ পরিমাণে ছোলা রয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তাই ছোলার দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। সরকারী তথ্যমতে, দেশে বছরে সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ওই হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে এক লাখ ২০ হাজার টন করে ভোজ্যতেল লাগে। তবে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে ২ থেকে আড়াই লাখ টন হয়। চলতি অর্থবছরের আট মাসে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে ১২ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেলের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া দেশে উৎপাদিত দুই লাখ টন সরিষার তেল বাজারে রয়েছে। অর্থাৎ পুরো বছরের চাহিদার সমান ভোজ্যতেল আট মাসেই ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছেছে। এছাড়া রমজানে ইফতারিতে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে শরবত ও জিলাপির। আবার শরবত তৈরির প্রধান উপাদান চিনি। প্রতিমাসে গড়ে এক লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে দেশে। রমজান মাসে তার চাহিদা হয় তিন লাখ টন। ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১৫ লাখ ৬৩ হাজার টন চিনি আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। দেশের কারখানাগুলো বছরে এক লাখ টন উৎপাদন করে। ফলে চিনির বাজারেও পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এছাড়া সারাবছর দেশে বছরে চার লাখ টন মসুর ডালের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজান মাসে প্রয়োজন হয় ৭০ হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৫ হাজার টন মসুর ডাল উৎপাদন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে ১ লাখ ৪৪ হাজার টনের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। রমজানে খেজুরের সবচেয়ে বেশি চাহিদা তৈরি হয়। ইফতারির আরও একটি প্রধান খাবার খেজুর। দেশে সারাবছর যে খেজুর বিক্রি হয় তার ৯৮ ভাগের বেশি বিক্রি হয় রমজান মাসে। ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা বছর ২০ হাজার টন খেজুর বিক্রি হয়। এর মধ্যে রমজান মাসে বিক্রি হয় ১৮ হাজার টনের বেশি। সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর এ পণ্য ৮ মাসে ২০ হাজার ৭০০ টন আমদানি হয়েছে।
×