ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এরা কোথায় নিচ্ছে দেশকে!

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১৬ মে ২০১৮

এরা কোথায় নিচ্ছে দেশকে!

ভেবে কূল খুঁজে পাচ্ছি না, আকস্মিকই যেন অদৃশ্য কোন শয়তানের যাদু বলে দীর্ঘ নয় বছর শান্তি ও উন্নয়নের ধারায় বসবাস করা মানুষ শান্ত, স্ব-স্ব কাজে ও পেশায় নিযুক্ত প্রায় সবাই সুখী। দেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন এক শান্ত সময়ে সমাজকে যেন দানবীয় থাবা আঘাত করছে! তা না হলে হঠাৎ করে সবকিছু ভেঙে পড়ছে কেন? ঠিক এই নির্বাচনী বছরেই? অনেক আগে থেকেই সমাজে একটা নতুন শ্রেণীর জন্ম হয়েছিল যারা প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ সমাজে প্রবাসী স্বামীর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সংখ্যাও বেড়ে গেল। এরা দেশে রেমিটেন্স যোগানদাতা। স্ত্রী-সন্তানরা স্বামী পিতার সাহচর্য বঞ্চিত পরিবার। এটাকে ‘প্রবাস সিনড্রোম’ও বলা হয়। এর ফলে তরুণী স্ত্রী যেমন তার দৈহিক চাহিদা অপূর্ণ থাকার কারণে প্রতিবেশী পুরুষের আহ্বান অনেক সময়ই প্রত্যাখ্যান করতে অক্ষম হয়, তেমনি তরুণী কন্যার ওপর নজর পড়ে আশপাশের কিছু লোভী পুরুষেরও। আবার দেশে থাকা স্বামীর পরকীয়া প্রেমের পরিণতিও হয় স্ত্রী-সন্তানদের জন্য দুর্বিষহ। সংখ্যায় কম হলেও কোন কোন স্ত্রী ও তার পরকীয়া প্রেমের বলি করেছে মা হয়ে প্রাণের চেয়েও প্রিয় সন্তানদের! পিতা প্রতিবেশীর ওপর প্রতিশোধ স্পৃহায় নিজ সন্তানকে, মেয়ে, ছেলেকে হত্যা করিয়েছে- এ ঘটনা মানুষের অমানুষ হয়ে ওঠার চিত্রই প্রকাশ করে। নিজ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য যে মা-বাবা নিজের প্রাণও অদল-বদল করতে চায়, সে মা-বাবাই যখন পুত্র বা কন্যাকে নিজের প্রেমের বাধা হিসেবে দেখে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিতে পদক্ষেপ নিতে দ্বিধাবোধ করে না, তা দেখে জাতি বিস্মিত। তারা এ প্রজন্মের এক শ্রেণী যারা তাদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু জানে না, বোঝে না। এদের হাতে অবোধ শিশু -পুত্র, কন্যা পথের বাধা ছাড়া আর কিছু নয়! এটা যদি কোন শিশু জানতে পারে, বাবা-মা তাদের নয়, অন্য কোন নারী বা পুরুষকে পৃথিবীর সবচাইতে কাক্সিক্ষত মনে করে এবং তাদেরকে পাওয়ার পথে শিশুদেরকে সে পথের বাধা মনে করে, তাহলে ওই শিশুগুলোর হৃদয়, বিশ্বাস, আস্থা, আদর, ভালোবাসা, সব ধসে পড়ে। ওরা কি আর কোনদিন স্বাভাবিক শিশুর মতো পড়াশোনা, খেলাধুলা করে বেড়ে উঠতে পারবে? এক কথায় এটি ভাবা অসম্ভব। শিশু যে বাইরের পৃথিবীতে চলা শুরু করার সময় মা, বাবার, দাদু, নানুদের হাত ধরে, তখন সে নিজেকে সবচাইতে বেশি নিরাপদ বোধ করে, আস্থার মানুষগুলোকে ধীরে ধীরে আরও আস্থায় নেয়। সে আস্থা ভেঙ্গে দিয়ে ঐ মা-বাবা কখনো নিজেরা সুখের নাগাল তো পায়ই না, বরং সন্তানের কাছে তারা অপরাধী। তখন তাদের জীবনটা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায় এবং জেলেই কাটাতে হয়, পুরো জীবন ধরে পেতে হয় সন্তানদের ঘৃণা। এই সামাজিক ব্যাধি দূর করতে হবে। পাশাপাশি ইদানীং দেখতে পাচ্ছি বাস-ট্রাক চালকদের অকল্পনীয় বর্বরতার আরেক নিদর্শন। হঠাৎ করেই গাড়ি চালকদের মধ্যে পথচারী মানুষের প্রাণকে তুচ্ছ করে এক অমানবিক প্রতিযোগিতার চালানোর ফলে দেখা যাচ্ছে রাজপথে বাসে বাসে ধাক্কায় এক বাসের যাত্রী তরুণ ছাত্র ছাত্রের হাত ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে এক বাস, আরেক বাস পথযাত্রীর পা ছিঁড়ে থেঁতলে দিয়ে চলে গেছে, অন্য এক বাস শিশু কন্যার দুই পা গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে, এমন আরও অনেক ক্ষমার অযোগ্য ফাঁসির দণ্ড হবার মতো অপরাধ বাস-ট্রাক-ভ্যান চালকরা করে চলেছে। আরও বিস্ময়কর এ জন্য যে, চালকরা এই নির্বাচনী বছরেই কেন তথাকথিত ছাত্রলীগের ক্যাডারদের গু-ামী, মারাদাঙ্গার অনুকরণে এবছরই পরপর যাত্রী, পথচারীদের পিষে দিচ্ছে, গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, আবার বাসে তরুণী ধর্ষণের চেষ্টাও চালাচ্ছে? সম্প্রতি ভারতে ১২ বছরের নিচের শিশু ধর্ষণের জন্য প্রাণদণ্ড দেবার আইন প্রণয়নও সমাজের দাবি। এ আইনের অনুসরণে আমাদের দেশেও শিশু ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড আইন বাস ট্রাক চালক ও মালিকদের অপরাধের জন্য সমান দায়ী করে বিচারের আওতায় আনা জরুরী। শুধু চালক নয়, বাস-ট্রাক মালিকদেরও দ-ের আওতায় এনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য মৃত্যুদণ্ড ও কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ক্ষতিপূরণ দেবার আইন করা হলে এই অমানবিক বিবেকহীন ঘৃণ্য অপরাধের রাশ টেনে ধরা অনেকাংশে সম্ভব হবে। তরুণ অনাথ রাজীব এমনই একটি ছেলে, যারা আমাদের ‘ইনডোমিটেবল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করার একজন বিশ্বস্ত, নির্ভরশীল যোদ্ধা ছিল। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি অনাথ ছেলেটি তার দুটি ছোট অনাথ ভাইদেরও অনন্যোপায় হয়ে সম্ভবত: মাদ্রাসায় বিনা খরচের ধর্মশিক্ষা কেন্দ্রে রেখে পড়ার, খাওয়া, থাকার ব্যবস্থা করছিল। ওর ভালো চাকরির ইন্টারভিউ দিতেই দুর্ঘটনার দিন সে যাচ্ছিল। অথচ দুই বাস চালকের হৃদয়হীন নির্মম প্রতিযোগিতার বলি হয়ে প্রায় আমাদের সবার আশা জাগিয়েও শেষপর্যন্ত ব্রেনের আঘাত যেটি সম্ভবত হাত বিচ্ছিন্ন হবার কারণে শুরুতে সুচিকিৎসা পায়নি, সেটিই তাকে আমাদের সব প্রার্থনাকে পরাজিত করে ওর পক্ষে অভাবিত এক অগ্রহণযোগ্য মৃত্যুর কাছে হার মানতে হল! মাঝে মাঝে এমন কোন কোন তরুণ-তরুণী-শিশুর রোগ দুর্ঘটনায় বা সহকর্মী অথবা পরিবারের, প্রতিবেশির কারো দ্বারা মারাত্মক আহত হওয়া আমাদের মনে স্থায়ী আঘাতের ক্ষত হয়ে ওঠে। রাজিব বা পরপর সংঘটিত হাত, পা ভেঙ্গে পঙ্গু হওয়া, নিহত হওয়া তরুণ-তরুণী-শিশুরাও তাই করেছে। এ ঘটনাগুলো আমাদের এতটাই ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ, শোকার্ত ও বেদনার্থ করে যেÑ আমরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তর্গত সমাজ ব্যবস্থা, যান চলাচল ও দুর্বল অনাধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা, যানবাহনের-মালিক চালকের সামন্ততান্ত্রিক অতি প্রাচীন অর্থ লোলুপ মুনাফা সর্বস্ব আচরণ থেকে উদ্ভুত অমানবিক প্রতিযোগিতাকে এর জন্য সর্বৈবভাবে দায়ী করি। আমাদের দুর্ভাগ্য, রাজীবের দুর্ভাগ্য। যে অকাল প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যে সুন্দর, সুসজ্জিত আধুনিক ঢাকা শহর উপহার দেবার কাজে হাত দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল বাসগুলোকে, বাস মালিকদেরকে কয়েকটি কোম্পানিতে ভাগ করে রুট অনুযায়ী সেগুলোর চলাচলে ব্যবস্থা করা, তার মৃত্যুর পর সেই সুন্দর ব্যবস্থাটি অবাস্তবায়িত থেকে গেল! অথচ মেয়র সাঈদ খোকন, রাজপথ ও সেতুমন্ত্রীকে নিয়ে দুই সিটি কর্পোরেশনের সাহায্যে এতদিনেও এই অতি প্রয়োজনীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা কি যেত না? এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আশা করি, মেয়র ও রাজপথ ও সেতুমন্ত্রীর উদ্যোগে এবং বাস মালিকদের সহযোগিতায় এটি রাজীবসহ হাজার হাজার রাজপথের দুর্ঘটনায় নিহতদের মৃত্যু শোকের ওপর দিয়ে অন্যদের প্রাণ রক্ষার জন্য বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করি। এ ধরনের অমানবিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের মধ্যে বাস মালিক ও বাস চালক উভয়কে রেখে তাদের জন্য অপরাধ বিশেষে বিশেষ দ-ের বিধি, জরিমানা, ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দান এর বিধান রাখতে হবে। যতক্ষণ বাস- ট্রাক মালিকরা দুর্ঘটনার দায়ে দায়ী হবে না, ততক্ষণ চালকদেরও যথার্থ দ-ে দ-িত করা কঠিন হবে। অথচ আমরা চালক ও মালিক উভয়ের দায় থাকায় উভয়েরই বিচার ও দণ্ড জরুরী। বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে যেমন ঋণের নামে অর্থ লুটের কারখানাতে পরিণত করছে একদল অর্থলোভী স্বার্থসর্বস্ব মানুষ নামের অমানুষ, তেমনি গণপরিবহনকে জনগণের রক্ত শোষক, যন্ত্র দানবে পরিণত করেছে বর্তমানের একদল রক্ত চোষা যানবাহন মালিক নামধারী অমানুষ। এদের হাত থেকে সত্যিকার অর্থে পরিবহনকে মুক্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। অথচ, তার পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে আকস্মিকভাবে এই নির্বাচনী বছরেই যেন বাস চালকরা পরপর অনেক সুস্থ যাত্রী, পথযাত্রীকে পঙ্গু এবং নিহত করে চলেছে! এরকম বর্বর কা- গত বছর বা তার আগের বছরগুলোতেও দেখা যায়নি, পথের দুর্ঘটনা হয়েছে, মানুষও মারা গেছে, কিন্তু হাত, পা ছিঁড়ে নেয়া, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া, যার ফলে প্রাণঘাতী হয়েছে অনেক দুর্ঘটনা, সেটি এবারই দেখা যাচ্ছে? প্রায় প্রত্যেক পরিচিতজনই এ প্রশ্ন তুলছে- ১. এ বছরেই কোটা বিরোধী আন্দোলন অনুষ্ঠিত হলো কেন? এ কোটা তো ৪৭ বছর ধরে আইনে ছিল যদিও ৩০ বছর প্রায় এর বাস্তবায়ন আইনমত ছিল না। ২. এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর। কোটার সঙ্গে যার বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই, বাড়ির সব রকমের জিনিসপত্র, গাড়ি, এমনকি টয়লেট, আলমারি ভেঙে চুরমার করা হয়েছে, আলমারির গয়না, অর্থলুট হয়েছে, আশ্চর্যজনকভাবে ফ্রিজের রাখা খাবার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছেÑ যা এক কথায় অবিশ্বাস্য। সে ঘটনাটি মধ্যরাতে কেন, কারা ঘটাল? ৩. এ বছরই কেন বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান একের পর এক তরুণ-তরুণী, শিশুদের ধাক্কা দিয়ে পিষে মেরে হত্যা করছে, পঙ্গু করছে? সংখ্যাটি এ বছর এত বেশি কেন? মানুষ হত্যার একি একটি পদ্ধতি হিসেবে এ বছর কোন গোষ্ঠী দ্বারা উদ্ভাবিত হলো? হত্যা গুলো, পঙ্গুত্বকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে কেন একটি পদ্ধতি বা নিয়ম দেখা যাচ্ছে যা দুর্ঘটনায় থাকার কথা নয়? এই দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আসে রাস্তাঘাটের অবস্থা। আজকে কলকাতা শহর একটি আধুনিক উন্নতমানের রাস্তা, নিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও পরিবহন ব্যবস্থার কারণে আধুনিক শহরে পরিণত হয়েছে। ভারতের রাজ্যগুলোর রাজপথ, হাইওয়ে দেখে ভাবি কখন এমন সমান, খানাখন্দহীন, পীচ ওঠা, ক্ষতবিক্ষত গর্ত হীন, বৃষ্টি ড্রেনের ময়লা পানিহীন তকতকে রাস্তা কবে দেখব কে জানে। সরকার তো জানেই যে, ঢাকা এখনো কোন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের রাজধানীর মতো স্মার্ট সিটি হতে পারেনি। এই বিগত নয় বছরে ঢাকার রাজপথ, গণপরিবহন উন্নত করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল। কিন্তু দায়িত্বশীলরা দায়িত্ব পালন করেনি বলে ঢাকা লজ্জাজনকভাবে এখনও মফস্বল শহরের অবস্থায় পড়ে আছে। ফ্লাইওভার হয়েছে এর মধ্যে মগবাজার-তেজগাঁও ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার ভ্রমণ সময় যথেষ্ট হ্রাস করেছে। অন্য কয়েকটি প্রায় সময় যানশূন্য থাকে। এখন মেট্রোরেল, এক্সপ্রেস ওয়েব অপেক্ষায় আছি, অন্তত রাজীবদের মতো তরুণ-তরুণীদের, বৃদ্ধ-শিশুদের চলাচলের নিরাপদ ব্যবস্থা হয়তো তখন হবে, এ আশায় আছি। তবু, রাজপথকে রাজার চলাচলের উপযুক্ত, সুন্দর, অটোমেটিক সিগন্যাল, জলহীন, তারবিহীন, আবর্জনাবিহীন না করা পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে দেখে লজ্জাই পাই। এ লজ্জা দূর করার দায় সরকারের। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×