ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ব্লাড ম্যানেজার’ এ্যাপস নিয়ে কামরুল

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১৫ মে ২০১৮

‘ব্লাড ম্যানেজার’ এ্যাপস নিয়ে কামরুল

স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে এদেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বেশকিছু সংগঠন, এর মধ্যে খুবই কার্যকর প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টিতে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের সন্দ্বীপের ছেলে মোঃ কামরুল হাসান। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ ব্লাড ডোনারস ফোরাম’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বর্তমানে দেশের সবকটি জেলায় কাজ করছে বাংলাদেশ ব্লাড ডোনারস ফোরামের সক্রিয় টিম। আজ কামরুলের সাক্ষাৎকারে জানব ভিন্ন কিছু। লিখেছেনÑ বেনজির আবরার ডিপ্রজন্ম : কামরুল, কীভাবে এই সংগঠনটির কথা মাথায় এলো? কামরুল : আমার এক আত্মীয়র সিজার অপারেশনের জন্য বিরল এ নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়। সেই রক্তের জন্য হন্যে হয়ে রক্তদাতা খুঁজেছি আমরা। ব্লাড ব্যাংক আর মেডিকেলগুলোতে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না দুর্লভ গ্রুপের এই রক্ত। এদিকে ডাক্তার জানালেন, দ্রুত সিজার করতে না পারলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। এরপর দিশেহারা হয়ে সবাইকে ফোন দেয়া শুরু করলাম। রক্তের প্রয়োজনীয়তাটি পোস্ট করলাম ফেসবুকেও। আমার এক বন্ধু মেহেদী এ ধরনের সেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে এক ব্যাগ এ নেগেটিভ রক্তদাতা খুঁজে দেয়। এত দ্রুত রক্তদাতা খুঁজে পেয়ে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আজ থেকে রক্তের প্রয়োজনে মানুষকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করব। সে অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি চিন্ত করতে থাকি কীভাবে দেশের সকল স্বেচ্ছাসেবক ও রক্তদাতাদের একটি প্ল্যাটফর্মের ভেতর নিয়ে আসা যায়। যাতে দেশের যে কোনো প্রান্তে খুব দ্রুত রক্তদাতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। এই চিন্তা থেকে ফেসবুকে বিভিন্ন জেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠকদের নিয়ে একটি গ্রুপচ্যাট খুলি। জেনে নেই, কে কীভাবে কাজ করছে। বুঝতে পারলাম বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো কাজ করছে নিজ জেলা বা উপজেলা ভিত্তিক। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সারাদেশে ছড়িয়ে দেবো বাংলাদেশ ব্লাড ডোনারস ফোরামের কার্যক্রম। ডিপ্রজন্ম : বিভিন্ন জেলার রক্তদাতা ও সংগঠনকে উৎসাহিত করতে আপনারা সংবর্ধনা দিয়েছেন। কতজন রক্তদাতা বা সংগঠনকে সংবর্ধনা দিয়েছেন বিস্তরিত বলুন। কামরুল : ২০১৫ সালে জাতীয় রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম সিটিতে বিভিন্ন জেলার ২০০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা ও ৩০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সংবর্ধিত করি । এর পর ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে ২য় বর্ষপূতি উপলক্ষে বিভিন্ন জেলার ৩০০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা ও ৪০টি সংগঠনকে সংবর্ধিত করি। রক্তদাতা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যাপক উৎসাহ দেখে স্বপ্ন জাগে দেশের প্রতিটি বিভাগে পর্যায়ক্রমে রক্তদাতা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সংবর্ধিত করার। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে জাতীয় রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে ঢাকা সিটিতে বিভিন্ন জেলার ৫০০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা ও ৫০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সংবর্ধিত করি। ঐ প্রোগ্রামে দেশের ৫৪ জেলার রক্তদাতা ও স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করে। এরপর ৩য় বর্ষপূতি উপলক্ষে সিলেট শহরে বিভিন্ন জেলার ৪০০ জন রক্তদাতা ও ৫০ টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠকে সংবর্ধিত করি। এছাড়া ও সন্দ্বীপে রক্তদানের পর ৩৫০ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাকে সংবর্ধিত করি। শুধু রক্তদান ও রক্তদাতাদের সংবর্ধিত করার মধ্যে থেমে থাকেনি আমাদের সংগঠনটির কার্যক্রম। ৪০ হাজার মানুষের বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করার পাশাপাশি গর্ভবতী মায়ের সচেতনতা ও রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে জন সচেতনতা তৈরি করতে ৫০ হাজার লিফলেট ও ৬ হাজার ফেস্টুন পথে প্রান্তরে বিলি করেছি। রোহিঙ্গাদের নির্মম হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেটে মানববন্ধন করেছি, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ, দেশের প্রতিকূল অবস্থায় বর্ন্যাতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প, পরিষ্কার-পরিছন্ন কর্মসূচী, অসহায়দের আর্থিক সহায়তা প্রদান, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনসহ নানা ধরনের সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। ডিপ্রজন্ম : বাংলাদেশে সবচেয়ে কার্যকর রক্তদানের এ্যাপস আপনাদের তৈরি বলে শোনা যাচ্ছে, বিষয়টি যদি পাঠকদের জন্য পরিষ্কার করতেন। কামরুল : বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্তদান কার্যক্রমকে আর সহজ করতে সম্প্রতি আমরা ‘ব্লাড ম্যানেজার’ নামে একটি ডিজিটাল এ্যাপস চালু করেছি। যেখানে ৬৪ জেলায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবক এর তালিকা দেয়া আছে অর্থাৎ যার যে জেলায় রক্তের প্রয়োজন হবে এ্যাপসের মাধ্যমে রক্তগ্রহীতারা সে জেলায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কাক্সিক্ষত রক্তদাতার সন্ধান নিতে পারবে। এছাড়াও সরাসরি এ্যাপস থেকে ওই গ্রুপের রক্তদাতা খুঁজে নিতে পারবে। এ্যাপসের বিশেষ সুবিধা হচ্ছে যাদের ৪ মাস রক্তদানের সময় হয়েছে তাদের অটো গ্রীন সিগনাল কালার চলে আসবে। যাদের সময় হয়নি তাদের লাল কালার আসবে। এ্যাপসে রক্তদাতারা নিজের ছবিসহ নিবন্ধন করতে পারবে সহজেই। এ্যাপসের মাধ্যমে মেডিক্যাল টিম এর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবে। রক্তদানের সচেতনতা ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তরিত তথ্য জানতে পারবে। আমি সকল রক্তদাতাদের অনুরোধ করছি এ্যাপসে রক্তদাতা হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য । ডিপ্রজন্ম : প্রতিবন্ধকতা কি ধরনের এই সামাজিক কার্যক্রমে? কামরুল : জি, অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা রযেছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রক্তের প্রয়োজনে আমরা ফেসবুকে রোগীর যাবতীয় তথ্য ও ফোন নাম্বার সহ পোস্ট করে থাকি। পোস্ট থেকে খুব দ্রুত রক্তদাতার সাড়া পাওয়া যেত। কিন্তু এখন একদল দালাল চক্র সেই ফেসবুক পোস্ট থেকে রোগীর নাম্বার নিয়ে রোগীর লোককে রক্ত দিতে বলে গাড়িভাড়া বাবদ বিকাশে টাকা চায়। টাকা পাওয়ার পর ঐ লোক ফোন বন্ধ করে দেয়। এতে রোগী রক্তদাতার আশায় আশায় আরো মুমূর্ষু অবস্থায় পরে। তাই পোস্টকারী রোগীর লোককে অবশ্যই মনে রাখা উচিত পোস্ট থেকে কেউ রক্ত দিবে বলে টাকা চাইলে বুঝে নেবেন সে দালাল চক্রের সদস্য। ডিপ্রজন্ম : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আপনাদের সম্প্রতি স্বীকৃতি দিয়েছে। এবিষয়ে বলুন- কামরুল : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক টিম বাংলাদেশে এসে রক্তদান নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সে আয়োজনে বাংলাদেশ ব্লাড ডোনারস ফোরামকে সম্মাননা তুলে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম প্রোগ্রামে যাব কিনা। যাবার পর তাদের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে কাজের গতি আরো বেড়ে গেল। তাছাড়া পুলিশ ব্লাড ব্যাংক, লায়ন্স ক্লাব, বীর প্রতীক কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম ফাউন্ডেশন সহ ১২ টি সংগঠন থেকে সংবর্ধিত হই।। ডিপ্রজন্ম : এই যে এত কার্যক্রম। এর পেছনে সমর্থন দিচ্ছেন কারা? কারা করছেন অর্থনৈতিক সহযোগিতা? কামরুল হাসান : আমাদের উপদেষ্টা ও একাধিক পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন যারা কেউ পরামর্শ দিয়ে, কেউ অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করছেন। তারা হলেন- বীর প্রতীক কর্নেল (অব.) মোহাম্মেদ দিদারুল আলম, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল এর পরিচালক এবিএম ওয়াহিদুর রহমান, আহসান জামীল টেকনিক্যাল সেন্টার এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সারওয়ার এহসান জামীল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল এর উপ-পরিচালক রোটারিয়ান মোশাররফ হোসাইন, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এর সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ লিয়াকত জাহান, প্রমুখ। ডিপ্রজন্ম : ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই- কামরুল : সারাদেশের প্রত্যেক উপজেলায় কার্যকরি টিম গঠন করে রক্তদানের এই সেবা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি প্রত্যক জেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রক্তদাতাদের আরও উৎসাহিত করতে পর্যায়ক্রমে সংবর্ধনার আয়োজন করতে চাই। ৬৪ জেলায় রক্তদাতার সন্ধান দিতে শ্রীঘ্রই কল সেন্টার চালু করারও পরিকল্পনা রয়েছে। সারাদেশের রক্তদাতাদের আমাদের ব্লাড ম্যানেজার এ্যাপসের আওতায় আনতে ৫০ হাজার স্টিকার করার উদ্যোগ নিয়েছি। রক্তের অভাবে যাতে একটি রোগীর মৃত্যু না হয় সেই স্বপ্ন দেখছি। ইনশাআল্লাহ আমাদের এই প্রজম্মই রক্ত সঙ্কটের সমাধান করবে।
×