ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়ায় ১৫০ ফুট বাঁধ যমুনায় ॥ আতঙ্কে তীরবাসী

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৫ মে ২০১৮

বেড়ায় ১৫০ ফুট বাঁধ যমুনায় ॥ আতঙ্কে তীরবাসী

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা থেকে ॥ বেড়া উপজেলার পেঁচাকোলায় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত যমুনা নদীর ডানতীর স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধের ১৫০ ফুট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ধসে যাওয়া অংশ সংস্কার না করায় এর পরিধি বাড়ছে। প্রতিরক্ষা বাঁধের কোল ঘেঁষে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করায় এই ধসে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার অনেক জায়গা থেকে সাপোর্টিং ব্লক চুরি হয়ে গেছে। এ কারণে প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এতে আগামী বর্ষা মওসুমে পানির ঘূর্ণায়মান স্রোতের টানে ও ঢেউয়ের আঘাতে হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের নাকালিয়া বাজার, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ জনপদ ভাঙ্গনের হুমকিতে পড়েছে। মোহনগঞ্জ এলাকায় ৩টি পয়েন্টে নদী ভাঙ্গন প্রতিরক্ষা বাঁধের টপ ৮ ফুট, দৈর্ঘ্যে ২ থেকে ৩ ফুট এবং মালদাহপাড়ায় ২টি পয়েন্টে ১০ ফুট, দৈর্ঘে ৫ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত বাঁধের টপ দেবে গেছে। সিসি ব্লক আলগা হয়ে পড়েছে। প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচে নদীতে ফেলা সাপোর্টিং ব্লক অনেক জায়গা থেকে চুরি হয়ে গেছে। মোহনগঞ্জ ও মালদাহপাড়ায় প্রতিরক্ষা বাঁধের লাগানো দুটি ইট ভাঁটির লোড ট্রাক চলাচল করছে। ট্রাকের ঝাঁকুনিতে প্রতিরক্ষা বাঁধের সিসি ব্লক আলগা হয়ে যাচ্ছে। পেঁচাকোলা পয়েন্টে প্রায় এক বছর আগে ১৫০ ফুট এলাকার সিসি ব্লক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পাউবোর বেড়া কৈটোলা নির্মাণ বিভাগ থেকে আজ পর্যন্ত ধসে যাওয়া অংশ মেরামত বা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তারা বলছে, অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া সংস্কার কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা বাঁধের কোল ঘেঁষে বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর তলদেশের ২৫-৩০ ফুট গভীর থেকে পাইপের সাহায্যে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তার চার পাশের এলাকা ধসে যাচ্ছে। ফলে প্রতিরক্ষা বাঁধটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বর্ষা মওসুমে যমুনা নদীর মূল ধারাটি সরাসরি মোহনগঞ্জ ও মালদাহপাড়ায় এলাকায় আঘাত করে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলো সংস্কার না করা হলে স্রোতের টানে ও ঢেউয়ের আঘাতে বাঁধটি ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০০০ সালে এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেড়ায় গত ৪০ বছরের অব্যাহত নদী ভাঙ্গনে যমুনা ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে এসেছে। এ সময়ে যমুনার ভাঙ্গনে ৭২টি গ্রাম, ১০ হাজার একর ফসলি জমি, ১২টি হাটবাজার, ৩৫টি স্কুল-মাদ্রাসা, ১৫টি মসজিদ-মন্দির, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার মানুষ অন্য এলাকায় বাড়ি করেছে, সহায়-সম্বল হারিয়ে ১৫ হাজার মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। নদী ভাঙ্গনে ভূমিহীন হয়ে ৫ হাজার মানুষ শহরে বস্তিবাসী হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে যমুনা নদী স্থায়ী ভাঙ্গন রোধের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশের আলোকে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বেড়ার মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার যমুনা নদীর পশ্চিম তীর স্থায়ী ভাঙ্গন রোধ প্রকল্প হাতে নেয়। পানি উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তৎকালীন জোট সরকার আমলে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা-মেঘনা রিভার ইরোশন মিটিগেশন প্রকল্পের আওতায় যমুনা নদীর সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গন প্রবণ বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী স্থায়ী ভাঙ্গন রোধ প্রকল্পের কাজ ২০০৪ সালে শুরু হয়ে ২০০৮ সালে শেষ হয়। প্রায় ৭ কিলোমিটার যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে (ডান তীর) প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়। প্রতিরক্ষ বাঁধ নির্মাণের ফলে মোহনগঞ্জ থেকে রাকশা পর্যন্ত যমুনা নদীর ভাঙ্গন বন্ধ হয়ে যায়। নদীর পশ্চিম পাড়ে জেগে উঠেছে চর। এই কাজে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ না করে গ্লোবাল পজিশনিং (জিপিএস) পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। সফলভাবে গ্লোবাল পজিশনিং (জিপিএস) পদ্ধতি প্রয়োগ করে স্থায়ী ভাঙ্গনরোধ প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করায় গত ১১ বছর এলাকাবাসী যমুনা নদী ভাঙ্গনের তা-বলীলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। এর ফলে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, কৈটোলা পাম্পিং স্টেশনসহ ৩০টি গ্রাম ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। এতে যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকাবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার না করা, সিসি ব্লক চুরিসহ যমুনা নদীর পাড় ঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতিরক্ষা বাঁধের ১৫০ ফুট ধসে গেছে। যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ ভাঙ্গন আতঙ্কে ভুগছে।
×