ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবলময় বাপনের আপন ভুবন...

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৫ মে ২০১৮

ফুটবলময় বাপনের আপন ভুবন...

রুমেল খান ॥ বৈশাখের রোদেলা দুপুর এবং ভ্যাপসা গরমেও প্রাণবন্ত ফুটবল খেলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। গত ৮ মে সেই কাজটিই করে দেখায় টাঙ্গাইল অ-১৪ বালিকা ফুটবল দল। কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘জেএফএ কাপ অ-১৪ বালিকা জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর ফাইনালে তারা ৩-০ গোলে হারায় প্রতিপক্ষ ঠাকুরগাঁওকে। সর্বশেষ ২০১৭ আসরের চূড়ান্ত পর্বের সেমিফাইনালে টাঙ্গাইল টাইব্রেকারে ৩-৪ গোলে হেরে গিয়েছিল এই ঠাকুরগাঁওয়ের কাছেই। শিরোপা জেতার পাশাপাশি সর্বোচ্চ গোলদাতা (৮ গোল) এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়েরও পুরস্কার (শাহেদা), পায় স্কুলটি। ফুটবলে কোন দল সাফল্য পেলে সেটার আসল কৃতিত্ব কোচের। টাঙ্গাইল দলের কোচ গোলাম রায়হান বাপন। বাংলাদেশ যুব গেমসের পর থেকেই এই দলটিকে একসঙ্গে রেখেছিলেন। প্রায় আড়াই মাসের মতো দলটাকে যথাসাধ্য অনুশীলন করিয়েছেন। জেএফএ কাপের প্রতি আসরেই টাঙ্গাইল দলের কোচ ছিলেন বাপন। এছাড়া বঙ্গমাতা ফুটবলের সাত আসরেও টাঙ্গাইলের বাগুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোচ ছিলেন। ২০১৬ আসরে স্কুলটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে। এছাড়া জাতীয় নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের গত দুই আসরেই টাঙ্গাইল জেলা দল সেমিফাইনাল খেলেছে। সেই দলেরও কোচ ছিলেন। ছেলেদের জাতীয় আন্তঃস্কুল ও মাদ্রাসা ফুটবলে টাঙ্গাইলের সুতি ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় পাঁচবার (২০০৭, ০৯, ১৩, ১৪, ১৬) চ্যাম্পিয়ন এবং একবার রানার্সআপ (১১) হয়েছে। আর মেয়েদের বিভাগেও এই স্কুল হ্যাটট্রিক (২০১১, ১২, ১৩) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। প্রতিবারই দলের কোচ ছিলেন বাপন। ২০০৮ সালে সিটিসেল স্কুল ফুটবলেও বাপনের স্কুল দল তৃতীয় হয়েছিল। জেএফএ অ-১৪ বালিকা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে একমাত্র লক্ষ্মীপুর ছাড়া বাকি সব দলেই একাধিক প্রতিভাবান ফুটবলার আছে বলে মনে করেন বাপন। নিজ দলের শাহেদা, রেহানা, উন্নতি, প্রান্তি ... এরা জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া রংপুরের বৃষ্টি, ময়মনসিংহের সালমাও জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পেতে পারে ধারণা বাপনের। বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের কিংবদন্তিতুল্য কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের ছোট ভাই গোলাম রায়হান বাপন। ছোটনের চেয়ে দু’বছরের ছোট বাপন। দুই ভাইয়ের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই মিল। দুজনের চেহারায় মিল, পেশায় মিল, দুজনেই একসময় ফুটবল খেলেছেন। তবে কিছুটা মিলও আছে। ছোটনের মাথায় চুলের ঘাটতি থাকলে বাপনের সেটা নেই! ছোটন একসময় ছেলেদের ফুটবলের কোচ থাকলেও এখন শুধুই মেয়েদের ফুটবল কোচ। আর বাপন ছেলে-মেয়ে উভয় ফুটবল দলেরই কোচ। মজার ব্যাপারÑ ছোটন বড় হলেও বাপনই তার আগে বিয়ে করেছেন এবং এক ছেলেও আছে তার। আর ছোটন বাবা হওয়ার অপেক্ষায়! ছেলে রাফাতকেও ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন দেখেন বাপন। বাপন শুধু ফুটবল কোচই নন, তিনি একজন স্কুল শিক্ষকও বটে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর সুতি ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে গেম টিচার হিসেবে কর্মরত আছেন গত ২১ বছর ধরে। ছোটনের মতো বাপনও একসময় ঢাকার ফুটবলে খেলেছেন। ১৯৮৯ সালে পাইওনিয়ার ফুটবলে কদমতলা সংসদের হয়ে শুরু। সেবার দল চ্যাম্পিয়ন হয়। দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে বাসাবো তরুণ সংঘ, মালিবাগ অভিযাত্রিক ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ এবং ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের জুনিয়র দলেও খেলেছেন। তার পজিশন ছিল রাইট ব্যাক। মজার ব্যাপারÑ ছোটনও ছিলেন রাইট ব্যাক! বাপন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যখন খেলতাম, তখন অবশ্য স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলেছি। ঢাকায় খেলতে এসে পজিশন বদলে যায়।’ ছোটনের সঙ্গে অবশ্য একই ক্লাবে খেলার সৌভাগ্য হয়নি বাপনের। ঢাকায় আসর আগে টাঙ্গাইলে প্রথম বিভাগ ফুটবলে থানাপাড়া যুব সংঘ, উদয়ন ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া খেলেছেন জেলা সদর এবং রাজশাহী মোহামেডানের হয়েও। ফেডারেশন কাপে ১৯৯৫ আসরে খেলেছেন বাসাবো তরুণ সংঘের হয়ে। দলটি সেবার শেষ আটে খেলে। ছোটন তার বড় হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্কটা একেবারেই বন্ধুর মতো, ‘আমরা দুজনেই পরস্পরের কাছে সবকিছু শেয়ার করি। তিনি কোচিং বিষয়ে আমাকে সববময়ই নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।’ বাপনরা মোট পাঁচ ভাই। তিনিই সবার ছোট। বাকি তিনজনের একজন সাবেক জেলা ক্রীড়া অফিসার, একজন কাস্টমসে চাকরি করেছেন, আরেকজন ব্যবসায়ী। জেএএফএ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাপনের কান্নাজড়িত কণ্ঠের প্রতিক্রিয়া, ‘দল জিতেছে। এজন্য আল্লাহ্র কাছে হাজার শুকরিয়া। এ জীবনে কোচ হিসেবে অনেক সাফল্যই পেয়েছি। কিন্তু জেএফএ কাপের শিরোপা অর্জনটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অর্জন। কারণ এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে সারা দেশের সেরা স্কুলগুলো। তাদের মধ্যে সেরা হওয়ার অনুভূতিই আলাদা। ফাইনালের আগে অনেক চাপে ছিলাম। কেননা গত আসরে এই দলের কাছেই আমরা সেমিতে হেরেছিলাম। সারা বছর এই মেয়েদের নিয়ে পরিশ্রম করার ফল পেয়েছি!’ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ও ছোটনই ফুটবল খেলেছেন। ‘তবে আমার চেয়ে বেশি সিরিয়াস ছিলেন ছোটন ভাই। উনি যেকোন কাজই করেন আন্তরিকভাবে। তাকে দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হই।’ বাপনের ভাষ্য। ‘সি’ লাইসেন্সধারী কোচ বাপনের লক্ষ্য কোচ হিসেবে আরও শাণিত হওয়া। তবে ‘এ’ লাইসেন্স পেতেই হবেÑ এমন উচ্চাকাক্সক্ষা পোষণ করেন না বাপন, ‘আমি তৃণমূল ফুটবল নিয়েই কাজ করতে বেশি আগ্রহী। আমরা বাচ্চারা ফুটবল শিখে জাতীয় দলে খেলবে, এটাই আমার স্বপ্ন। আমি ফুটবল ভালবাসি। সারাজীবন ফুটবল নিয়েই কাজ করে যেতে চাই।’
×