ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

১৫ বছরে নির্মাণ ব্যয়ের তিনগুণ টাকা উঠে আসবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৫ মে ২০১৮

১৫ বছরে নির্মাণ ব্যয়ের তিনগুণ টাকা উঠে আসবে

ফিরোজ মান্না ॥ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় হবে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে স্যাটেলাইটটির কাজ শুরু হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ভাড়া বাবদ এই টাকা আসবে। দেশের ভেতরেও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। এখান থেকেও বিরাট অঙ্কের টাকা সরকার রাজস্ব পাবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সাশ্রয় হবে বছরে ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। স্যাটেলাইটের ‘লাইভ টাইম’ ১৫ বছরের মধ্যে নির্মাণ ব্যয়ের তিনগুণ টাকা উঠে আসবে বলে সরকার আশা করছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক দিক নিয়ে জনকণ্ঠকে জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য এবং বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেয়া হবে। ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) সেবা, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সম্প্রচার ও ইন্টারনেট সুবিধাসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য সরকারী মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। তারা বাণিজ্যকভাবে ‘মার্কেটিং করবে’। দর্শক ও শ্রোতার কাছে সরাসরি পৌঁছতে টেলিভিশন এবং বেতার স্টেশনগুলো ব্রডকাস্টিং সেবা ব্যবহার করবে। ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারীরা আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) ইন্টারনেট সেবা দিতে স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে পারবেন। মোবাইল ফোন ও ল্যান্ড ফোন অপারেটররা তাদের সাবস্ক্রাইবারদের সঙ্গে সংযোগ তৈরির জন্য স্যাটেলাইটের টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহার করতে পারবে। দেশের সব জায়গায় কেবল সংযোগ না থাকায় মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা দেয়া বিঘœ ঘটছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই সেবা সহজে দেয়া যাবে। সবার জন্য সুলভ মূলে ইন্টারনেট দেয়া সম্ভব হবে। দেশের ভেতরেও স্যাটেলাইটের একটি বাণিজ্য রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, স্যাটেলাইট থেকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা কতটা রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্যাটেলাইট থেকে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে বড় ধরনের লাভবান হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি ন্যাশনাল প্রাইড বা জাতীয় গৌরবের অংশ হিসেবেই দেখছে। আমরা স্যাটেলাইটকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য ইতোমধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ফিলিপিন্স ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। এসব দেশের কাছে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। আমরা প্রাথমিকভাবে একটা হিসাব করেছি। তাতে আগামী ১৫ বছরে এর তিনগুণ টাকা উঠে আসবে। শুধু যে টাকা উঠে আসবে এটা বড় কথা নয়। জাতি হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে এমন একটি উচ্চতায় আমরা অবস্থান করব সেটা টাকা দিয়ে বিচার করা যাবে না। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ জানিয়েছে, স্যাটেলাইটটি ১৫ বছর মেয়াদে সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ ও ডেটা কমিউনিকেশনের কাজে ব্যবহার হবে। স্যাটেলাইটটির ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ১৪টি সি ব্যান্ড ও ২৬টি কেইউ ব্যান্ডের। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর লাইফ ১৫ বছর। তবে ডিজাইন লাইফ টাইম ১৮ বছর। বাকি তিন বছর স্যাটেলাইটটি গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। টেলিযোগাযোগের জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বড় ভূমিকা পালন করবে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বড় ভূমিকা পালন করবে। এর মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বিস্তৃত করা, ভি-স্যাট ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদান করা, বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার এবং ডিটিএইচ সেবা অর্থাৎ বর্তমানে কেবল টিভির যে সংযোগ আছে সেটির মান উন্নয়ন হবে। ইন্টারনেট সার্ভিস ব্যবসায়ীরা সব চেয়ে বেশি বেশি সুবিধা পাবেন। ট্রিপল প্লে (ডিশ, ইন্টারনেট ও কলিং) এ তিনটি সেবা একসঙ্গে ডিটিএইচের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। এতে প্রত্যন্ত এলাকায় এই সুবিধা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর বড় গ্রাহক হবে। বেসরকারী টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন বা অ্যাটকোর এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো অ্যাপস্টার সেভেন নামের একটি বিদেশী স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। বিদেশী স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ বাংলাদেশের প্রতিটি টেলিভিশন স্টেশন মাসে ২৪ হাজার ডলার খরচ করতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে ব্যান্ডউইথ পেতে এত টাকা খরচ হবে না। তাছাড়া দেশের টাকা দেশেই থেকে যাবে। বাংলাদেশের সব টেলিভিশন চ্যানেলের বিদেশী স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে মোট খরচের পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ ডলার। বছরে এ খরচ এসে দাঁড়ায় প্রায় ১৮০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের এমডি সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশে স্যাটেলাইট প্রকল্পের আরও অনেক বেশি টাকার প্রকল্প রয়েছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তা নিয়ে কারো প্রশ্ন নেই। যত প্রশ্ন উঠছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে। স্যাটেলাইট কি শুধু লাভের জন্য কোন দেশ উৎক্ষেপণ করে। তা কিন্তু করে না। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে ওই দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রসারিত করার জন্য। বাংলাদেশ কিন্তু দুটি বিষয় মাথায় রেখে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। একটি দেশের টেলিযোগাযোগ সুবিধা ও জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া অন্যটি বাণিজ্যিক দিক। বাণিজ্যিক দিক নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা হয়েছে। তাদের কাছে স্যাটেলাইটের ২০ টি ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। স্যাটেলাইটটির সফল উৎক্ষেপণের জন্য আজ মঙ্গলবার হাতিরঝিলে বড় একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। উৎসবে দেশের সব মানুষকে সম্পৃক্ত করা হবে। আমরা স্যাটেলাইটকে টাকার অঙ্ক দিয়ে বিচার করছি না। এটা বাংলাদেশের মর্যাদার একটি বিষয়। মর্যাদা কখনও টাকা দিয়ে কেনা যায় না। পৃথিবীর ৫৭ টি দেশের কাতারে এখন বাংলাদেশ। যারা স্যাটেলাইট নিয়ে বিরূপ কথা বলছেন তারা অল্প দিনের মধ্যে স্যাটেলাইটের সুফল পেতে শুরু করবেন। তখন আর তাদের কিছু বলার থাকবে না। বাংলাদেশের টেলিকম খাতের বিশেষজ্ঞ আবু সাইয়িদ খান বলেন, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বাজার লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই স্যাটেলাইটের জন্য যে টাকা খরচ হয়েছে, তা আগামী সাত বছরের মধ্যে উঠে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদি স্যাটেলাইটটি পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালনা করা হয়, তাহলে এ বিনিয়োগ উঠে আসা কষ্টকর কোন বিষয় নয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে দুটি চ্যালেঞ্জ আছে। স্যাটেলাইটের অবস্থান ও এর দূরত্ব। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো বর্তমানে অ্যাপস্টার নামে যে স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে সেটি বাংলাদেশের উপরে ৯০ ডিগ্রীতে অবস্থান করছে। অ্যাপস্টার সেভেনের মাধ্যমে একদিকে দুবাই ও অন্যদিকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত সম্প্রচারের সুবিধা পাওয়া যাবে। বর্তমানে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এজন্য বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই ব্যয় সাশ্রয় হবে।
×