ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মতো স্থানীয়রাও স্বপ্ন দেখেন শীঘ্রই রফতানি হবে বিদেশেও

কালুহাটির জুতা-স্যান্ডেল উত্তর জনপদ পেরিয়ে আসছে ঢাকায়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ মে ২০১৮

কালুহাটির জুতা-স্যান্ডেল উত্তর জনপদ পেরিয়ে আসছে ঢাকায়

ওয়াজেদ হীরা, রাজশাহী থেকে ফিরে ॥ বড়াল নদের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা কালুহাটি গ্রাম। গ্রামে ছোট্ট ছোট্ট ঘর, তার মধ্যে বসে নানাবয়সী মানুষ তৈরি করছে বাহারি রঙের স্যান্ডেল ও জুতা। নারী-পুরুষের বাহারি জুতা তৈরি করা এ গ্রামটি আশপাশের সবার কাছে ‘পাদুকা পল্লী’ নামেই পরিচিত। এখানকার তৈরি বাহারি জুতা স্যান্ডেল যাচ্ছে গোটা উত্তরবঙ্গসহ রাজধানীতেও। দারিদ্র্য ঘোচানো গ্রামটিতে কোন বেকার নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছরে অভাবী গ্রামের চেহারা পাল্টে কালুহাটি এখন ঝকঝকে কর্মচাঞ্চল্যের সাফল্যম-িত একটি গ্রাম। নানা সঙ্কট থাকলেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি। স্থানীয়রা স্বপ্ন দেখছেন একদিন বিশ^বাজারে রফতানি হবে কালুহাটির তৈরি পাদুকা। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের কালুহাটি গ্রামে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে জুতা-স্যান্ডেল তৈরির বিভিন্ন কারখানার সাইনবোর্ড। একেকটি ঘরই যেন একেক কারখানা! আর কারখানা ঘিরেই তাদের জীবন জীবিকা আর স্বপ্ন। সারাবছরই কর্মচাঞ্চল্য থাকা গ্রামটিতে রোজা এবং ঈদ কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে আরও কয়েক গুণ বেশি। মাটি আর বাঁশের বেড়ার তৈরি ঝুপড়ি ঘরে থাকা মানুষগুলো এখন সচ্ছলতা অর্জন করে তৈরি করেছেন পাকাবাড়ি। অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করা অধিকাংশ বাসিন্দাই এখন একেকটি জুতা কারখানার মালিক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাত হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মূলত এই শিল্পের বিকাশে এবং মান উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই ফাউন্ডেশন) সহায়তা ও দিকনির্দেশনায় দ্রুত পাল্টে গেছে গ্রামের চিত্র। পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। শান্ত ও অপেক্ষাকৃত ছায়াঢাকা এ গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এখন জুতা-স্যান্ডেলের কারখানা। কুটির শিল্পের আদলে গড়ে উঠেছে এসব কারখানা। অর্ধশতের বেশি পাদুকা কারখানা রয়েছে এই গ্রামে যেখানে উৎপাদিত হচ্ছে প্রতি মাসে ২ লাখ ৩৪ হাজার (জোড়া) জুতা-স্যান্ডেল। পাদুকার পাশাপাশি বাক্সের কারখানা আছে চারটি। আর কারখানায় কাজ করছেন পরিবারের সবাই। ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে গৃহবধূরাও যুক্ত জুতা-স্যান্ডেল বা বাক্স তৈরির কাজে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এ কারখানায় কাজ করে তাদের হাত খরচের টাকা উপার্জন করছে। অনেক নারী কর্মী কারখানার কিছু কাজ নিয়ে নিজেদের বাড়িতে বসেই করে দিয়ে যায়। এতে নারীরা যেমন স্বাবলম্বী তেমনি স্বচ্ছল হয়েছে সংসারের চাকাও। এসব কারখানার মাধ্যমে হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এ গ্রামে। আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার যুবকরা এসে এখানে কাজ নিয়েছেন। একই সঙ্গে আশপাশের গ্রামেও এখন কারখানা হচ্ছে। কারখানার মালিকরা বলেছেন এসএমই সহায়তায় তারা এই শিল্পকে বড় পরিসরে করার স্বপ্ন দেখেছেন। বাজার চাহিদা বাড়ায় ডিজাইন ও অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। একই সঙ্গে কমন ফ্যাসিলিটিস মার্কেট হলে আরও ভাল হয় বলেও জানান তারা। সরেজমিনে গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্রই যেন জুতার কারখানা। বাড়ি বাড়ি থেকে ভেসে আসে কারখানার বৈদ্যুতিক মোটরের শব্দ। কেউ শোবার ঘরে, কেউ বাইরে টিন দিয়ে ঘিরে কারখানা করেছেন। প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে রয়েছে সাইনবোর্ড। কনিকা সজু, আমিরুল সুজ, মান্নান সুজ, মুক্তি সুজ, সজিব সুজ, দোলা সুজ, শ্রাবণী সুজসহ নানা নামে অসংখ্য কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা। গ্রামের এক শিক্ষক বলেন, যেসব কারখানা মালিকের বাড়িতে পাকা ঘর দেখছেন, তা সবই জুতা-স্যান্ডেলের ব্যবসা থেকে হয়েছে। বেশিরভাগ কারখানা মালিকই এক সময় শ্রমিক ছিলেন। পরিশ্রমে তারা সাফল্য পেয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, পাদুকার উন্নয়নে ২০১০ সালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম ও এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অনেকেই ট্রেনিং পেয়েছেন। একই সময় ব্যবসায়ীদের এক ছাতার নিচে আনতে কালুহাটি পাদুকা শিল্প মালিক সমবায় সমিতি লি. গঠন করা হয়। যার সদস্য বর্তমানে ১১৭। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও দমাতে পারেনি মোঃ সোহেল রানা (৩২) তরুণ উদ্যোক্তাকে। ২০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা এই তরুণের এখন পুঁজি ২২ লাখ টাকা। এক সময় তিন জন কাজ করত আর এখন পার্টনার ব্যবসাসহ মোট ৬৮ জন শ্রমিক খাটাচ্ছে। উৎপাদিত স্যান্ডেল রাজধানীর নামীদামী শোরুমে সরবরাহ করছেন। বর্তমানে তিনি পাদুকা শিল্প মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক। জনকণ্ঠকে বলেন, রমজানে আমাদের কাজ ও বিক্রি দু-ই বেশি হয়। আমরা ব্যবসা শুরুর পর শুধু এখানের বাজারে বিক্রি করতাম। এসএমই ট্রেনিং পেয়ে বুঝলাম এর চাহিদা আছে। আমরা এখন উত্তরবঙ্গের সব জেলায় এই স্যান্ডেল সরবরাহ করি। এ ছাড়াও ঢাকায় কিছু যায় খুলনায়ও যায়। প্রায় ৭ হাজার মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে আর এ সবের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতার কথাও বলেন তিনি। তার মতে, আমরা অন্যান্য জায়গার অনেক কারখানা ঘুরে দেখেছি তবে তারা আমাদের শ্রমিকদের মতো কাজে দক্ষ নয় বলেই মনে হয়েছে। আমাদের শ্রমিকরা সব ধরনের কাজই পারে। এছাড়াও এই শিল্পের আরও বড় বিকাশে গ্রুপ ভিত্তিক বড় লোনের কথাও বলেন। যেভাবে পাল্টে গেছে এই গ্রাম ॥ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক দশক পরেও এ কালুহাটি গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার ছিল নিম্ন আয়ের। ওই সময় গ্রামের অত্যন্ত অভাবী পরিবারের ১২-১৫ বছরের ছেলে আমিরুল ইসলাম আর বারিক ঢাকায় সিদ্দিক বাজারে কাজ নেন একটি জুতা-স্যান্ডেলের কারখানায়। টানা ৯ বছর সেখানেই কাজ করেন। ১৯৮৫ সালের দিকে আমিরুলের মাথায় আসে, এ কাজ তারা গ্রামের মানুষকে শেখালে গ্রামের অভাব দূর করা সম্ভব। তিনি গ্রামে চলে আসেন কিন্তু তখনও তার একটি কারখানা করার মতো পুঁজি হয়নি। তিনি গ্রামের মানুষকে ব্যবসায়ের সম্ভাবনার কথা বোঝালেন। ব্যবসা নিয়ে সে সময় আশঙ্কায় কেউ এগিয়ে আসতে চায়নি। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের বেকার যুবক নওশাদ আলী সরকার। তিনি কারখানায় পুঁজির যোগান দিলেন। একটি ঘর নিয়ে তারা কারখানা শুরু করেন। একটা সময় সৈয়দ নামের এক ব্যক্তিও কাজ করেন। শুরু হলো কাঁচামাল কিনে নিয়ে এসে জুতা-স্যান্ডেল তৈরি আর বাজারে বিক্রি। এভাবে দিনে দিনে ব্যবসার সম্ভাবনার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একে একে অনেকেই কাজ শিখতে থাকে। এই গ্রামের অনেকেই তা কাছে সরাসরি কাজ শিখেছেন বলেও জানা যায়। বর্তমানে আমিরুল সুজ নামে নিজের বাড়িতেই দিনরাত শ্রমিকসহ কাজ করেন এই উদ্যোক্তা। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের এই কাজটা ভাগ্যের পরিবর্তন করে দিয়েছে। ভাল লাগে এখন সবাই এই কাজ করছে। আগে কেউ করতে চায়নি। আমাদের গ্রামটি এখন অনেক পাল্টে গেছে। সিজনাল সময়ে সময় মতো ঋণ সুবিধা পেলে অনেকের উপকার হবে বলে মত দেন তিনি। গত বছর বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড হুগো বসের জুতায় ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখে নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এই কালুহাটির পাদুকা পল্লীর সফলতাকে আরও বড় কিছু করার স্বপ্নের কথা লেখেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ শাহরিয়ার আলম। তার স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও আশায় বুক বেঁধেছেন একদিন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশে^র বিভিন্ন বাজারে যাবে কালুহাটির তৈরি জুতা।
×