ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘কুয়াকাটার সোনার নৌকা’ ব্যতিক্রমী প্রত্ন সম্পদ- সংরক্ষণের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৪ মে ২০১৮

‘কুয়াকাটার সোনার নৌকা’ ব্যতিক্রমী  প্রত্ন সম্পদ- সংরক্ষণের উদ্যোগ

মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ কুয়াকাটার সোনার নৌকা! শুনলেই যে কেউ চমকে ওঠার কথা। কুয়াকাটা সৈকতে জোয়ারের ঝাপটায় বালুর নিচ থেকে বেরিয়ে আসা প্রাচীন আমলের পাল তোলা জাহাজটিকে স্থানীয়রা এ নামেই চেনেন। স্থায়ীভাবে এ জাহাজটি মূল আদলে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য অত্যাধুনিক দর্শনীয় স্থাপনা তৈরি করা হবে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বিভাগ জাহাজটি সংরক্ষণে এমন উদ্যোগ নিয়েছে। এই অর্থবছরে কাজটি শুরু হচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে জাহাজটি সংরক্ষণের এমন উদ্যোগ নেয়ায় পর্যটক-দর্শনার্থীসহ কুয়াকাটাবাসী উদ্বেলিত। প্রাথমিকভাবে এ জাহাজটি ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কুয়াকাটা বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন বেড়িবাঁধের পাশে সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় পাঁচ বছর পরে প্রত্নতাত্ত্বিক এই প্রাচীন নিদর্শনটি রক্ষার জন্য আধুনিক স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতিসম্প্রতি এ কারণে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম কুয়াকাটায় জাহাজটি পরিদর্শন করে এ সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাচীন এ জাহাজটি দর্শনে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক-দর্শনার্থী ভিড় করে। কিন্তু যথাযথ সংস্কারের অভাবে জাহাজটি অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। অবকাঠামো ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাই সংরক্ষণ করতে আধুনিক নান্দনিক স্থাপনার মধ্যে সংস্কারের পরে জাহাজটি স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সূত্র মতে, পাল তোলা জাহাজটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রত্ন সম্পদ। বাংলাদেশে ইতোপূর্বে এই ধরনের জাহাজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। এটি কমপক্ষে দু’শ বছরের পুরনো। জাহাজটি জারুল কাঠের তৈরি। কাঠের পুরত্ব সাড়ে ছয় সেন্টিমিটার। কাঠ, লোহা ও তামার পাত দিয়ে তৈরি। জাহাজটি অবিকলভাবে সংরক্ষণ করে কুয়াকাটায় আধুনিক স্থাপনার মধ্যে স্থাপন করলে পর্যটকের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় হবে। ৭২ ফুট লম্বা ২৪ ফুট প্রস্থ এবং ১০ দশমিক ৬ ফুট উঁচু জাহাজটি। এটি বালুর নিচ থেকে তোলার কাজে নগরবাড়ি থেকে ১০ জন দক্ষ শ্রমিক ছাড়াও ৪২ জনের একটি শ্রমিক দল কাজ করেছে। পাঁচ সদস্যের কপিকল দল ছিল সর্বক্ষণিক। সাতটি কপিকল ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয় স্থানীয় ২০ শ্রমিক। এটি উদ্ধারকালে পাটের তৈরি ছালার নিদর্শন মেলে। পাটখরি, মাদুরের অবশেষ, শিকল ও তামার অসংখ্য পাত পাওয়া যায়। ভাঙ্গা মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহা দস্তার তৈরি ব্যালাস্ট পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে এ জাহাজটিকে ‘সোনার নৌকা’ বলা হয়। কারণ এর বাইরের আবরণ তামার পাতে মোড়ানো ছিল বলে মানুষ এটি নামকরণ করে। রাখাইনদের দাবি এ জাহাজটি তারা ২০০ বছর আগে ব্যবহার করেছেন। মতান্তরে সাধু সওদাগরে ধান-চালের সওদার কাজে ব্যবহৃত নৌকা। কেউ কেউ দাবি করেন পর্তুগীজদের ব্যবহৃত পাল তোলা ছোট্ট জাহাজ। ২০১২ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কুয়াকাটা সৈকতের ঝাউবাগান সংলগ্ন বেলাভূমের নিচে স্থানীয় জেলেরা প্রথমে প্রাচীন এ জাহাজটি দেখতে পান। সৈকতে জোয়ারের ঝাপটায় বালুর নিচ থেকে প্রাচীন আমলের জাহাজটি বেরিয়ে আসে। পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজন জাহাজটির বাইরের পিতলের প্রলেপ কেটে নিয়ে যায়। জাহাজটি নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে একাধিক সচিত্র প্রতিবেদন তখন প্রকাশ হয়। সরকারী ব্যবস্থাপনায় এটি সংরক্ষণে পুলিশী পাহারা বসানো হয়। একই বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে জাহাজটি পরিদর্শন করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ইভাস মারে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের তাড়াতাড়ি শিপিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইভাস মারে জাহাজটির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন। এর আগে নৌকা বিশেষজ্ঞ ইভাস মারে জন্মস্থান ফ্রান্স থেকে তার নিজের তৈরি নৌকায় চড়ে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। স্বচক্ষে এটির বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ শেষে ইভাস মারে তখন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এই নৌকাটি অসাধারণ এবং প্রাচীনকালের স্মৃতিবিজড়িত। নৌকাটির বয়স সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারেননি তিনি। তবে তার ধারণা এটি শত বছরের বেশি পুরনো। নৌকাটি গরান কাঠ দিয়ে তৈরি বলেও তিনি অনুমানের ওপরে বলেছিলেন। নৌকাটির সঙ্গে এখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের সম্পর্ক রয়েছে মন্তব্য করে এ কারণে অন্য কোথাও না নেয়ার পরামর্শ ছিল মারের। তার মতে, প্রাচীন এই নৌকাটি যে অবস্থায় রয়েছে এভাবেই সংরক্ষণ করলে দেশী-বিদেশী পর্যটক কুয়াকাটার প্রতি ভ্রমণে আকৃষ্ট হবে।’
×