ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যে ব্যবস্থাপত্রে রোজা নষ্ট হয় না

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৪ মে ২০১৮

যে ব্যবস্থাপত্রে রোজা নষ্ট হয় না

ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য রমজানের এক মাস রোজা রাখা ফরজ। এ সময় একজন মুসলিমকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোন খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গ্রহণ এবং মুখে ওষুধপত্র খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হয়। অনেক সময় রোগীরা একদিকে যেমন রোজা রাখতে চান, তেমনি অন্যদিকে রোগের কারণে বিভিন্ন ওষুধপত্র সেবন করাটাও বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, যেটা না করলে তার জীবন বিপন্নও হতে পারে। রোজা রাখা অবস্থায় অনেক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অপারেশন জরুরী হয়ে পড়তে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলো আগে ছিল না। যেমন ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দেয়া, ইনহেলার, রক্ত পরীক্ষা, এ্যান্ডোস্কপি, কোলনোস্কপি, বায়োপসি ইত্যাদিÑ এগুলো রোজাদার রোগীর জন্য জরুরী হয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় অনেক সময় রোজা পালনরত অবস্থায় রোগী এবং ডাক্তার উভয়েই রোজা রাখা ও না রাখা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। এমনকি অনেক ডাক্তার সঠিক পরামর্শ দিতে দ্বিধাবোধ করেন। এ সমস্যাগুলো সামনে রেখে রোজা রাখা অবস্থায় ওষুধ গ্রহণসহ বিশেষ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে কি যাবে না সে প্রশ্নের সমাধানকল্পে সারা বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের সুচিন্তিত অভিমত প্রদান করেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইসলামী আলেম-ওলামাদের সঙ্গে শরিয়তের সীমারেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরামর্শ ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রোজা থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকটি পন্থায় ওষুধ সেবন ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হবে না। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে মরক্কোতে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সমসাময়িক চিকিৎসা সমস্যা’ (An Islamic View of Certain Contemporary Medical Issues) শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়- যার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, কোন কোন মেডিক্যালজনিত কারণে চিকিৎসা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোজার কোন ক্ষতি হবে না। পরবর্তীতে নবম ফিকাহ-মেডিক্যাল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় যেখানে যৌথভাবে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে যৌথভাবে জেদ্দায় ইসলামিক ফিকাহ একাডেমি, মিসরের আল আজহার ইউনিভার্সিটি, আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক অফিস এবং ইসলামিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (ISESCO) উদ্যোগে এ বিষয়ে আরও সবিস্তারে আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। যার মূল আলোচনার বিষয়বস্তুও ছিল কী কী ভাবে ওষুধ সেবনে বা পরীক্ষা করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। ইসলামিক চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সর্বসম্মতিক্রমে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেন এবং অসুস্থ ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় নিম্নলিখিত ব্যবস্থাপত্র নিলে এমনকি প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে রোজা ভঙ্গ হবে না, সেই মর্মে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এই সেমিনারের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। ১. রোজা রাখা অবস্থায় চোখ, কান ও নাকে ড্রপ নেয়া যাবে। (চোখ বা নাকে ড্রপ দিলে তা মুখে চলে যেতে পারে, তা ফেলে দিয়ে কুলি করে ফেলা উচিত।) ২. হৃদরোগীদের বুকে ব্যথা হলে নাইট্রোগি সারিন স্প্রে বা ট্যাবলেট জিহ্বার নিচে নিতে পারবেন। ৩. মহিলা রোগীর তলপেটে পরীক্ষার জন্য যোনিদ্বার দিয়ে ডাক্তার বা নার্স হাতের আঙ্গুল অথবা কোন ডিভাইস প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না। এমনকি চিকিৎসার জন্য যোনিপথে পেসারি বা কোন ওষুধ ব্যবহার করা যাবে। ৪. মূত্রথলি পরীক্ষা বা এক্স-রে করার জন্য রোগীর প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে ক্যাথেটার অথবা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে অথবা ডাই প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হবে না। ৫. দাঁত তোলা, ড্রিলিং করা বা মেসওয়াক বা ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা যাবে, তাতে রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে এগুলো ব্যবহারের সময় সময় পাকস্থলীতে থুথু বা টুথপেস্ট যেন প্রবেশ না করে। ৬. মুখ পরিষ্কারের জন্য মাউথ ওয়াশ বা গড়গড়া বা মুখে স্প্রে জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে, তবে যেন পাকস্থলীতে কোন কিছু না যায়। ৭. রোগীর চামড়া, মাংস, অস্থিসন্ধি ও শিরায় ইনজেকশন দেয়া যাবে। কিন্তু স্যালাইন, ডেক্সট্রোজ, প্রোটিন জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা যাবে না। ৮. যে কেউ রক্ত অন্যকে দিতে পারবেন আবার জরুরী প্রয়োজনে নিজেও নিতে পারবেন। ৯. কোন রোগী অক্সিজেন অথবা অজ্ঞানকারী গ্যাস (এনেসথেসিয়া) নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না। ১০. চর্মের মাধ্যমে শরীরের ভেতরে যায় এমন মলম, ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে। ১১. পরীক্ষার জন্য রোগীর শরীর থেকে রক্ত নেয়া যাবে। এমনকি ডায়াবেটিস রোগীদের দিনের বেলায় রক্ত পরীক্ষা করাসহ প্রয়োজনে ইনসুলিন ইনজেকশন নেয়া যাবে, এতে রোজা নষ্ট হবে না। ১২. হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী হার্টের এনজিওগ্রাম এবং কার্ডিয়াক ক্যাথেটার করা যাবে। ১৩. রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বা চিকিৎসার অংশ হিসেবে এন্ডোস্কপি করলে রোজা ভাঙবে না। কিন্তু কোন তরল প্রবেশ করানো যাবে না। ১৪. জরায়ু পরীক্ষার জন্য শরীরে হিস্টারোস্কপি করা যাবে, এমনকি জরায়ুতে কোন যন্ত্রপাতি বা অন্যকিছু পরীক্ষার জন্য প্রবেশ করালে রোজায় কোন সমস্যা হবে না। ১৫. লিভার বায়োপসি অথবা অন্য কোন অঙ্গের বায়োপসি করলে রোজা নষ্ট হবে না। উপস্থিত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ নিম্নে বর্ণিত ব্যবহার্য বিধিও অনুমোদন করেন, যেমন: ১. নাকে স্প্রে বা হাঁপানি রোগীরা ইনহেলার ব্যবহার করতে পারবেন। ২. রোগীর পায়ুপথে ইনজেকশন অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আঙ্গুল বা অন্য কোন যন্ত্র প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না। ৩. জরুরী কোন অপারেশন প্রয়োজন হলে রোজা রাখা অবস্থায় করা যাবে। ৪. কিডনি অকেজো হলে রোগীর ডায়ালাইসিস করলে রোজা ভাঙবে না। এ মতামতগুলো নিয়ে অনেক রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে বিভ্রান্তি হতে পারে। কিন্তু এগুলো বিশ্বের ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তাই আমাদের দেশে চিকিৎসকরা এই মতামত রোগীদের দিলে, তারা যেমন সচেতন হবেন, তেমনি সঠিক নিয়মে রোজা পালন করতে পারবেন। যদি কারও মনে কোন বিভ্রান্তি দেখা দেয় বা কেউ যদি দ্বিমত পোষণ করেন, তবে আমাদের দেশীয় আলেম-ওলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতীয় মসজিদের ইমাম, এবং ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন চিকিৎসক একসঙ্গে বসে তাদের সুচিন্তিত অভিমতের মাধ্যমে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। প্রয়োজনে ধর্ম মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে, তা অত্যন্ত কার্যকরী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পুনশ্চ. উপরে বর্ণিত অনেক কিছুই বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন মাসওয়ালা মাসায়েল অনুযায়ী রোগী কোন্ কোন্ অবস্থায় রোজা রাখবেন বা রাখবেন না, তা নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু যে সমস্ত রোগী রোজা রাখতে বদ্ধপরিকর বা কোনক্রমেই রোজা ছাড়তে নারাজ, শুধু তাদের বেলায়ই উপরোক্ত মতামতগুলো প্রযোজ্য। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া অথবা ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা ছাড়া, সামান্য অজুহাতে রোজা ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×