ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সত্ত্বেও সুদের হার বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৪ মে ২০১৮

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সত্ত্বেও সুদের হার বেড়েই চলেছে

মাত্র কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যাংকের মালিকপক্ষ সাক্ষাত করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যাংক মালিকদের ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে এক অঙ্কে অর্থাৎ দশ শতাংশের নিচে নিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এ কথা সত্য যে, সুদের হার সম্পূর্ণ মুদ্রা বাজারের গতিবিধির ওপর নির্ভর করে এবং এখানে জোরপূর্বক তেমন কিছু করার নেই। এরপরও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয় এবং তিনি এই আহ্বান জানান যাতে করে সুদের হার অতীতের মতো মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছার আগেই ব্যবস্থা নেয়া যায়। সম্প্রতি ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি করেছে, যা ব্যবসায়ীদের ভাবিয়ে তুলেছে এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও উদ্বিগ্ন হয়েছেন। কেননা তিনি ভালভাবেই জানেন যে, এর ফলে দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের বেসরকারী বিনিয়োগ যে হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হার। তাছাড়া দেশের অর্থনীতির বর্তমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং আরও ত্বরান্বিত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী উভয় খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা। ব্যাপক বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হলো স্বল্পসুদে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের যোগান নিশ্চিত করা। অতীতে বেশ কয়েকবার অর্থনীতির নিয়মনীতি এবং মুদ্রাবাজারের স্বাভাবিক শর্ত অনুসরণ না করেই কিছুটা ওপর মহলের সিদ্ধান্তে জোরপূর্বক সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যার পরিণাম মোটেও শুভ হয়নি। ২০০৪-৫ সালের দিকে একরকম জোরপূর্বক সুদের হার এক অঙ্কে অর্থাৎ দশ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। সে সময় সুদের হার কমানোর কারণে মুদ্রাবাজারে চরম তারল্য সঙ্কট দেখা দেয় যার ফলে কলমানি রেট অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে এক পর্যায়ে ৬০%-৭০% -এ পৌঁছায়। এমনকি বিগত ২-৩ বছর ধরে সুদের হার এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিটে) নামিয়ে আনার যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল তাও স্থায়ী হয়নি, উল্টো সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ক্রমাগত। উচ্চ সুদের হারের প্রকৃত কারণ নির্ধারণ না করে জোরপূর্বক হ্রাস করতে গেলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সুতরাং ব্যাংকের মালিকপক্ষ, নির্বাহী কর্মকর্তা এবং দেশের অর্থনীতিবিদরা এখন নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে উচ্চ সুদের হারের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেই সুদের হার কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এতে বর্তমানে সুদের হারের ক্রমাগত বৃদ্ধি রোধ হবে এবং তা কমে সহায়ক পর্যায়ে নেমে আসবে। দেশে ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হারের অন্যতম কারণগুলো হলো (১) ব্যাংক আমানতের ওপর অধিক হারে সুদ প্রদান, (২) ব্যাংকের অধিক মাত্রায় বা অনিয়ন্ত্রিত পরিচালনা ব্যয় বা অপারেশনাল কস্ট, (৩) যথাযথভাবে অটোমেশন বা সেন্ট্রালাইজেশন না করা, (৪) মাত্রাতিরিক্ত খেলাপী ঋণ, (৫) স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় প্রকার বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও আরও কারণ আছে তবে সেগুলো মুখ্য নয়। এই কারণগুলো সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে উপযুক্তভাবে সমাধান করতে পারলেই কেবলমাত্র ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার কমানো সম্ভব হবে। অন্য কোনভাবে সুদের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব নয়। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এখনও ঋণযোগ্য অর্থের জন্য ব্যাংকগুলোকে আমানত সংগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যাংককে প্রতিনিয়ত উচ্চ সুদের সরকারী সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এতে করে আমানত সংগ্রহ এবং ধরে রাখার জন্য উচ্চাহারে সুদ প্রদান ছাড়া ব্যাংকের আর কোন উপায় থাকে না, যা মূলত ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হারের অন্যতম কারণ। এছাড়া ব্যাংক আমানতের ধরন স্বল্পমেয়াদী, অথচ ব্যাংককে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদান করতে হয়। ফলে ব্যাংক প্রতিনিয়ত এক ধরনের তারল্য ঝুঁকিতে থাকে। যে কারণে ঋণের ওপর সুদের হার প্রায় ক্ষেত্রেই বেশি হয়ে থাকে। দেশের ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত এবং এই খেলাপী ঋণের পরিমাণ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এই মাত্রাতিরিক্ত খেলাপী ঋণের কারণে ব্যাংককে অধিক হারে নিয়মিত ঋণের ওপর সুদ আদায় করতে হয়, যা প্রকারান্তরে ঋণের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। কেননা খেলাপী ঋণের ওপর অর্জিত সুদ ব্যাংক কখনই নিয়মিত মুনাফা হিসেবে দেখাতে পারে না। উল্টো ব্যাংককে নিয়মিত মুনাফার একটি নির্দিষ্ট অংশ খেলাপী ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। এর ফলে ব্যাংকের বার্ষিক মুনাফা হ্রাস পায়, যা পুষিয়ে নেয়ার জন্য ব্যাংককে ঋণের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিতে হয়। তাই দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত খেলাপী ঋণের এই সমস্যার সঠিক সমাধান না করে ঋণের ওপর সুদের হার কমানোর প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হবে না। অনেকেই ভাবতে পারেন দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপী ঋণ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যার সঠিক সমাধান সম্ভব নয়। তাদের এই ধারণা মোটেই ঠিক নয়। সঠিক উদ্যোগ নিতে পারলে অবশ্যই খেলাপী ঋণ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ইতিপূর্বে এই প্রসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খেলাপী ঋণ সমাধানের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেশের খেলাপী ঋণ সমস্যার সমাধানের উপায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে একটি লেখা লিখেছিলাম। তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ইচ্ছা করলে এবং সঠিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে দেশের খেলাপী ঋণ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আরও একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদ এবং ঋণের ওপর ধার্য সুদকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। যে কারণে অতীতে প্রতিবারই ঋণের ওপর সুদ কমানোর মাধ্যম হিসেবে আমানতের ওপর সুদ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে হিতে বিপরীত ফল হয়েছে। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই দুটি বিষয়কে পৃথক করে দেখা হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমানতের ওপর সুদের হার হ্রাস বৃদ্ধির এক ধরনের প্রভাব, আবার ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাসবৃদ্ধির আরেক ধরনের প্রভাব। তাই এ দুটি উপাদান ব্যাংকিং ব্যবসার মূল বিষয় হলেও পৃথকভাবে বিবেচনা করেই ব্যাংকিং কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আমাদের ব্যাংকারদেরও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের ব্যাংকিং খাত বিগত কয়েক বছর ধরে খুব খারাপ সময় পার করছে। নতুনভাবে চালু হওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে দু’একটি পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে যার দায় সমগ্র ব্যাংকিং খাতকেই বহন করতে হচ্ছে। তাছাড়া খেলাপী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বিশেষ করে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক এবং বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের মতো বেশকিছু বৃহৎ অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনার কারণে সরকারকেও যথেষ্ট বিব্রত হতে এবং তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। যদিও এসব ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি কোন ভূমিকা নেই, তথাপি এর সমস্ত দায় দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। আমার অনেক লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে দেশের ব্যাংকিং খাতে পাহাড় সমান খেলাপী ঋণসহ যে অব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে তার সন্তোষজনক সমাধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে দেশের প্রতিটা বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাতে দেশের ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থার ঘটনাও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, তিনি এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত আছেন এবং সঠিক সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ তিনি অবশ্যই গ্রহণ করবেন। এর শুরুটাই হয়ত তিনি করেছেন ব্যাংকের মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সুদের হার কমিয়ে এক অঙ্কে অর্থাৎ দশ শতাংশের নিচে নিয়ে আসার আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান কার্যকর করতে গেলে এই খাতে বিরাজমান অনেক সমস্যার সমাধান সবার আগে করতে হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে শুধু ঋণের সুদ হ্রাসের আহ্বান হিসেবে বিবেচনা করা মোটেই ঠিক হবে না। আমরা আশা করব, আমাদের দেশের ব্যাংকের মালিকপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানের অন্তর্নিহিত অর্থ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি সহযোগিতা ও নির্দেশনা পেলে ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান সমস্যাগুলো খুব সহজেই দূর করে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। যেমনটা হয়েছে দেশের বিদ্যুত খাত, পদ্মা সেতুসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে। বিগত বছরগুলোতে দেশের ব্যাংকিং খাতে একের পর এক অঘটন ঘটলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এখন পর্যন্ত নিজস্ব উদ্যোগে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে দেখিনি কারণ এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিষয়। তাই এখন যখন এ বিষয়ে কথা বলেছেন তখন তিনি অনেক ভেবে চিন্তে এই খাতে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পরিকল্পনা সামনে রেখেই হাত দিয়েছেন। দেশের ব্যাংকারদের উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাব সঠিকভাবে বুঝে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাল করেই জানেন যে, দেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। দেশের এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখা এবং আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রয়োজন। এ কারণে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করার যথাযথ উদ্যোগ যে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ এসেছে দেশের ব্যাংকারদের সঙ্গে আলোচনা করে সুদের হার কমানোর আহ্বানের মধ্য দিয়ে। দেশের ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান অব্যবস্থাগুলো দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে কেবল কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রবর্তন এবং প্রতিযোগিতামূলক সুদনীতি চালু করার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সুদের হার কমিয়ে সহায়ক পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। এই উদ্যোগ এখনও শুরু না করার কারণেই প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সত্ত্বেও ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েই চলেছে। [email protected]
×