ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মাহাথির মোহাম্মদের প্রত্যাবর্তন ও তারুণ্যের রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৩ মে ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মাহাথির মোহাম্মদের প্রত্যাবর্তন ও তারুণ্যের রাজনীতি

মাহাথির মোহাম্মদ আবার ফিরেছেন গদিতে। মালয়েশিয়ায় যাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। নিঃসন্দেহে এর উন্নতি ও অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। সে দেশের মানুষের মনে দেশ নিয়ে অভিযোগ নেই। থাকলে আছে রাজনীতি নিয়ে। বহুজাতিক অস্ট্রেলিয়ায় আর সব দেশের মতো প্রচুর মালয়েশিয়ানের বসবাস। পর্যটক হয়েও নিয়মিত আসেন তারা। আমার পেশাগত কাজে পরীক্ষা হলে গিয়ে প্রায়ই মালয়েশিয়ান ছাত্রছাত্রীদের দেখা পাই। এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি তারা আর যাই হোক, ভারতীয়দের মতো সুযোগ খুঁজে নিজের অধিকার ফলানোর নামে বিরক্ত করে না। পাকিদের মতো উগ্র বা শ্রীলঙ্কানদের মতো হাবাগোবাও না। মালয়েশিয়াও একটি মিশ্র জাতি সত্তার দেশ। সেখানে মালয় চাইনিজ সাউথ ইন্ডিয়ান হিন্দু আর মুসমানদের বসবাস। বলাবাহুল্য, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে সম্প্রীতি আর শান্তি দুনিয়ার নানা দেশের মতো কখনওই ভয়াবহ হতে পারেনি। তারপরও মাহাথিরকে সবাই ভালবাসে এটা ভাবা ভুল। তাঁর রাজনীতিতে ভুল শুদ্ধ মিলিয়েই তিনি উজ্জ্বল। স্পষ্ট কথা আর নিজের ব্যাপারে কিছুটা অনড় এই ভদ্রলোক প্রমাণ করলেন তিনি কতটা জনপ্রিয়। ফের এ কথা বলি আমাদের ভ্রমণসঙ্গী মালয়েশিয়ান গোপালের মতো অনেকেই তাঁকে একতরফা জাতীয়তাবাদ আর সংকীর্ণতার জন্য দায়ী করেন। আছে আনোয়ারের সঙ্গে মতবিরোধিতা ও আইন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অভিযোগ। সে যাই হোক, তাঁর এই ফিরে আসার ভাল দিক খারাপ দিক দুটোই সামলাবে সেখানকার জনগণ। একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে সেটা তাঁর বয়স। মানুষের শরীর ও মগজ দুয়েরই সীমাবদ্ধতা আছে। যৌবনে মানুষ যেসব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে মাঝ বয়সে তাকে বিবেচনা করে বুদ্ধি দিয়ে। পরিণত বয়সে তার বুদ্ধির সঙ্গে যোগ হয় অভিজ্ঞতা। এরপর আসে সাবধানতা। আর এখন তিনি যে বয়সে সেখানে ঝুঁকি বা সাহসী কোন কিছু গ্রহণের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। মাহাথির তাঁর দেশকে নতুন কি দেন বা দিতে পারেন সেটার জন্য সবুর করার বিকল্প নেই। এখন আমরা যদি দেশের রাজনীতির সঙ্গে এই ঘটনাকে মিলিয়ে দেখি তাহলে এর ভেতর কি কোন বার্তা আছে রাজনীতির জন্য? আমাদের দেশের শীর্ষ নেতাদের অনেকের বয়স হয়েছে। মূলত যারা বয়সী তারাই এখনও নেতা। মুখে যত বলি না কেন তারুণ্য দেশে রাজনীতি বিমুখ। ছাত্র সংগঠনের নামে যে অনাচার বা যে রাজনীতি দুটোতেই সামান্য কিছু অংশগ্রহণ ছাড়া মূলস্রোতের তারুণ্য ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। রাজনীতিবিমুখতার জন্য তারা কতটা দায়ী বা তাদের কতটা ভূমিকা সে নেবে আলোচনার অন্ত নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে কোটা আন্দোলনের নামে আমরা যা দেখেছি তা মূলত ভয়ের। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে একদল বলা ভাল অজস্র তরুণ-তরুণীর এই মারমুখিতা তাও আবার মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কি কারণে? একি কেবলই ঝোঁক? না এর পেছনে খালি ইন্ধন কাজ করেছিল? সে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করেনি সরকারী দল। তড়িঘড়ি করে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে তারা আত্মসন্তুষ্টি বা সাময়িক পরিত্রাণ লাভ করেছে বটে ভবিষ্যতের কাছে জমা রয়ে গেছে কঠিন কিছু প্রশ্ন। রাজনীতিতে সমাধান প্রক্রিয়া এখন নেই বললেই চলে। সারাদেশে ঝড় তোলা বিপথগামী করার চেষ্টায় রাস্তা দখল করা হেফাজতকে ঠা-া করা হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়। ঠা-া করা আর সমাধান করা কি এক? একইভাবে বিএনপিকেও ঠা-া করে রাখা হচ্ছে। ঠা-া বা শীতল হয়ে আছে জঙ্গী রাজনীতি। জামায়াত কিংবা অন্যরা। মূল বিষয় কি আসলে ঠা-া রাখা? ডা-া দিয়ে ঠা-া করা চিরকালীন হলে আইয়ুব বা ইয়াহিয়াও পারত। পারত জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদ। সবাই একটা সময়ের পর আর পারেননি। আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের তাই জিজ্ঞাসা শেখ হাসিনা কি একাই সবকিছুর সমাধান বাতলাবেন? আপনারা যারা নেতা বা মাঠে আছেন আপনাদের ফিডব্যাক কোথায়? কোথায় জেলা জেলায় বা এলাকা এলাকায় রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধমুখী করার প্রয়াস? যারা পারতেন মানে যারা সংস্কৃতি ও বামধারার মানুষ তাদেরও ঠা-া করে রাখতে হবে কেন? আলোচনা-সমালোচনা তর্ক-বিতর্কে রাজনীতি পথ খুঁজে না পেলে হতাশ তারুণ্য আমি রাজাকার লিখে রাস্তায় নামতে চাইবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? গোপন বিষয়ের আকর্ষণ দুর্নিবার। যেসব দল বা মতের কথা লিখলাম তারা প্রকাশ্যে সুবিধা করতে না পেরে সরে আছে বটে তাদের গোপন কার্যক্রম তো থামেনি। তারা ঘরে ঘরে সক্রিয়। ফলে এটা মানতেই হবে বিষের চারা রোপণ হচ্ছে প্রতিদিন। আর আমরা বা সবাই মিলে কোন কারণে সবকিছুতে হাঁ-হাঁ করব? যেখানে না বলতে হবে সেখানে না বলব না? এভাবেই কিন্তু তারুণ্যকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে রাজনীতি। অথচ শুদ্ধধারা চললে রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকত বন্ধ্যাত্ব থাকত না। বিরোধী দলগুলোও কম দায়ী না। তাদের রাজনীতি আদর্শ হারিয়ে ক্লিব। তাদের উদ্দেশ্য একটাই শেখ হাসিনাকে সরানো। কেন? তিনি কি করেছেন? তিনি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। দেশের মানুষকে ভাল রাখছেন। তাঁর ব্যক্তি ইমেজ এখন আকাশছোঁয়া তার মানে তাঁকে সহ্য করা যাবে না? তাঁকে টার্গেট করা বিরোধী রাজনীতি মূলত আক্রমণ আর হিংসা নির্ভর বলেই জনগণের দোরগোড়ায় যেতে পারছে না। ফলে কি হচ্ছে? বয়সী নেতাদের দেয়ার সামর্থ্য লোপ পেলেও তারাই ঘুরে ফিরে থাকছেন লাইম লাইটে। মূলত সারা দুনিয়ায় এখন এ ধরনের সমস্যা। যে কারণে আবারও মাহাথিরকে দরকার পড়ল মালয়েশিয়ায়। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে জয় যদি আসেন তো তিনি তরুণ। বিএনপিতেও আছে এমন বয়সী নেতা। ভারতে আছেন রাহুল। সেদিন বিবিসিতে বেনজীর পুত্র বিল্লালের আলাপ শুনলাম। খুব ভাল বলে না বটে কিন্তু দারুণ বলে। আর চোখে মুখে যে দীপ্তি ও তেজ এবং আধুনিকতা সেটা ভাললাগার মতো। এরা যদি সামনে না আসে তো দেশ নতুন পথ খুঁজে পাবে কি করে? রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেস প্রস্তুত করার পরও সেখানে বিজেপি ও বামের বয়সী নেতারাই গদি আঁকড়ে আছেন। কারণ, রাজনীতিতে তারুণ্য নেই। অথচ কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে দেখুন। ঝলমল করছেন। তাই আমাদের এটা বোঝার সময় এসেছে কেন তারুণ্য নেই আর থাকলেও কেন তারা সামনে আসতে পারছে না। তবে মাহাথির মোহাম্মদকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। কিছু মানুষের এমন দাপট এমন পাওয়ার থাকে। তারা নব্বইতেও তরুণ। আমরা একবারও বলি না যে, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। মিডিয়ায় বা সংস্কৃতিতে অভিজ্ঞ প্রবীণরা না থাকলে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাঁরা আছেন বলেই সমাজ ও দেশ পথ খুঁজে পায়। তবে তাদের সহযোগী সহকর্মীরা হবেন মূলত তরুণ-তরুণীরা। তবেই সাহস আর প্রজ্ঞা হাত ধরাধরি করে পথ চলতে পারবে। শেষ করব একটা শোনা কথা দিয়ে। শুনলাম মাহাথির মোহাম্মদের সাফল্যের খবরে দারুণ উজ্জীবিত বোধ করছেন এরশাদ সাহেব। এমন কি বিএনপিও নাকি বলছে বয়স আসলে ফ্যাক্টর না। তাদের এই আশা মূলত হতাশার আরেকটি রূপ। পরিত্যাজ্য বা জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত নেতা আর অবসরে গিয়ে ফিরে আসার মতো বুকের পাটার নেতা এক? এরা সেটাও বোঝেন না। মানুষ বার বার তাদেরই ফিরিয়ে আনে যারা তাদের নয়নের মণি বা সাহস ও শক্তির উৎস। আজ যদি বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীন কিংবা সৈয়দ নজরুল ফিরে আসেন, ভোটও লাগবে না। মানুষ তাদের কাঁধে চড়িয়ে দেশ শাসনে বসিয়ে বলবে; আমাদের মার্জনা করে শাসন করুন। সে জায়গাটা তৈরি করা ভুলে যাওয়া রাজনীতিতে ভ্রান্তি বিলাস যেতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। [email protected]
×