ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈরী আবহাওয়ায় পচে যাচ্ছে ফসল

বজ্রপাতের কারণে মাঠের পাকা ধান কাটতে পারছে না হাওড়বাসী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৩ মে ২০১৮

বজ্রপাতের কারণে মাঠের পাকা ধান কাটতে পারছে না হাওড়বাসী

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ বৈরী আবহাওয়া, ভারি বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাতের কারণে মৌলভীবাজারের হাওড় অঞ্চলের কৃষকরা মহা বিপাকে পড়েছে। পাকা বোরো ধান মাঠে দোল খাচ্ছে কিন্তু কয়েক দিনে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গায় বজ্রপাতে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ভয়ে ধান কাটতে মাঠে যাচ্ছে না কৃষক। পাঁচ শ’ থেকে ছয়শ’ টাকায়ও ধানকাটা শ্রমিক মিলছে না। আবার বাড়িতে সম্প্রতি যে ধান তোলা হয়েছে রোদের অভাবে এসব ধান শুকানো যাচ্ছে না। কয়েক দিনের মধ্যে আবহাওয়া অনুকূলে না এলে এ জেলার ৯ হাজার হেক্টর জমির পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে সুনামগঞ্জের হাওড়ে এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও প্রয়োজনীয় রোদের অভাবে কাটা ধান গজিয়ে উঠছে। অবশ্য এ জেলায় সনাতন ও প্রচলিত পদ্ধতিতে এসব ধান শুকানোর চেষ্টা চলছে। জেলার ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দক্ষিণা সুনামগঞ্জ ও সদর উপজেলার প্রায় সকল উপজেলার কৃষকের কাটা ধানে চারা গজিয়েছে। গজিয়ে ওঠা এসব ধান নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। অনেক কৃষক ধান সংরক্ষণ করতে না পেরে পানিতে ফেলে দিয়েছেন, অনেকে আবার অল্প দামে ধান ফড়িয়া ও মিলারদের কাছে বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে ধান শুকানোর জন্য ড্রায়ার মেশিন কেনার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। নিজস্ব সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার থেকে জানান, জেলার হাওড় অঞ্চলে ৫৪ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৪৫ হাজার হেক্টর বোরো ধান কাটা হয়েছে। অবশিষ্ট ৯ হাজার হেক্টর ধান নিয়ে কৃষকরা পড়েছেন মহাবিপাকে। পাকা বোরো ধান মাঠে দোল খাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাশিত সে ধান ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক। গেল প্রায় ১৫-১৬ দিন থেকে এ সঙ্কট ঘনিভূত হচ্ছে। কারণ সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকছে । এরই সঙ্গে থাকছে ঝড়ো হাওয়া, বিজলি চমকানো, ভারি বৃষ্টি ও বজ্রপাত। গেল কয়েক দিনে বজ্রপাতে জেলায় ১২ জন নিহত হওয়ায় বজ্রপাত আতঙ্ক বিরাজ করায় কৃষক ভয়ে ধান কাটতে যাচ্ছে না। আর এ কারণে অনুকূল আবহাওয়া না হলে কেউই ঘর হতে বের হচ্ছে না। কাউয়াদীঘির হাওড় পাড়ের কৃষকরা জানান, বৈরী আবহাওয়ার কারণে হাওড়ে কাটা ধান বৃষ্টিতে পচে যাবার উপক্রম। তাছাড়া হাওড় পাড়ের একমাত্র সড়কে কাদা জমে থাকায় গাড়ি বোঝাই করে ধান মুঠেও আনা যাচ্ছেনা। আরও ৪/৫দিন বৃষ্টি হলে কাউয়াদীঘি হাওড়ের পুরো ধান পচে নষ্ট হয়ে যাবে। বাড়িতে যেসব ধান উঠানো হয়েছে, রোদের অভাবে সব ধান পচে যাচ্ছে। ৫শ-৬ শ টাকা মজুরি দিয়েও মিলছেনা ধান কাটা শ্রমিক। কৃষকরা জানালেন, আরও সপ্তাহ দিন আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে জেলার মোট বোরো আবাদের ১০-১৫ ভাগ ফসল ঘরে উঠানো যাবে না। নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ থেকে জানান, এ জেলার সুনামগঞ্জে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন এ জেলার হাওড়বাসীর পিছু ছাড়ছেই না। হাওড়ে বাম্পার ফলনের পর সোনার ফসল গোলায় তোলে যেখানে কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব করার কথা সেখানে একের পর এক দুর্যোগ পিছু লেগেই আছে হাওড়বাসীর। ধানকাটা শ্রমিক সঙ্কট, অপ্রয়োজনীয় বাঁধের কারণে মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতা আর প্রাকৃতিক দানব বজ্রপাতে একের পর এক প্রাণহানি কাটতে না কাটতেই নতুন সঙ্কট টানা বৃষ্টিপাত আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে স্তূপ স্তূপ ধানে চারা গজিয়ে নষ্ট হচ্ছে জেলার কৃষকের লাখ লাখ মণ ধান। জেলার ১১ টি উপজেলার হাওড়ে হাওড়ে কৃষকের ধান বাড়িতে আসলেও রৌদ্র না থাকায় ধানের ওপর চারা গজিয়ে উঠছে। নষ্ট হচ্ছে সোনালি ধান। দীর্ঘ ১৩ দিন ধরে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় হাওড় থেকে আসা ধানগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ যেন এক দুর্যোগের পর আরেক দুর্যোগ। আর এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে, ধানে যেন চারা না গজায় এ জন্য সনাতন পদ্ধতি কিংবা প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষণ করছেন অনেক কৃষক। যারা এই পদ্ধতি অনুসরণ করেননি তারা নামমাত্র দামে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন ফড়িয়া ও মিলারদের কাছে। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কৃষকদের ড্রায়ার মেশিন (ধান শুকানোর যন্ত্র) কেনার পরামর্শ দিচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এই রকম সঙ্কটময় মুহূর্তে যারা ড্রায়ার মেশিন কিনতে পারছেন না সেইসব কৃষকরা গ্রামীণ প্রচলিত প্রথা ব্যবহার করতে পারেন। নিজেদের ধান রক্ষা করতে কৃষকরা সনাতন ও প্রচলিত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করছেন। সনাতন পদ্ধতিতে কাটা ধান বস্তায় ভরে ধান পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর কিছুদিন রক্ষা রাখা যায় এবং এই ক’দিন ধানে চারা গজায় না। কিন্ত এই পদ্ধতিতে ধানে চারা না গজালেও ধান থেকে যে চাল হয় তার স্বাদ কমে যায়। তবে এ পদ্ধতি কোন অবস্থাতেই এই ধানকে মাটিতে লাগতে দেয়া যাবে না। যদি পানির নিচে বস্তাবন্দী ধান মাটিতে লেগে যায় তাহলে ধান পচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ পদ্ধতি থেকে ভাল হলো প্রচলিত পদ্ধতি। প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষণ করা হয়, স্তূপ করে না রেখে একটি শুকনো জায়গায় নিচে পলিথিন দিয়ে উপরে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে মেলে রাখা যেত। এতে ধানের তাপমাত্রার পরিমাণের ভারসাম্য ঠিক থাকত। জায়গা না পেলে কৃষকরা এই পদ্ধতিতেও ধান ভিজিয়ে রাখতে পারেন। এতে ধানে চারা বা হিজা গজানোর জন্য যে পরিমাণ বাতাস, আলো, অক্সিজেন, তাপমাত্রা দরকার তা হবে না। চারা গজানোর জন্য যে পরিমাণ পানি থাকার কথা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে পানি হওয়ায় পুকুরে রাখা বস্তার ধানে চারা গজাতে পারে না। বৃষ্টিপাতের কারণে ধান নষ্ট হওয়ার চেয়ে এই প্রচলিত বা সনাতন পদ্ধতিতে ধান রক্ষা করা এখন খুবই জরুরী। সরেজমিন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার হাসকুড়ি গ্রামের প্রবীণ কৃষক আমান উল্লাহ জানালেন, এইসব পদ্ধতিতে আমার বাপ-দাদার আমল থেকে রেখে আসছি কিন্তু এটি স্থায়ী কোন প্রক্রিয়া নয়। কিছুদিন যদিও এভাবে রাখা সম্ভব। তারপরও রোদে শুকানোর কোন বিকল্প নেই। একটানা এতদিন রোদ উঠেনি আমি আমার ৭০ বছরের জীবনে দেখিনি। কেন এই পদ্ধতিতে ধানে চারা গজায় না জানতে চাইলে বলেন, শুকনায় থাকলে এই ধানে বাতাস লাগবে। ভিজা ধানে বাতাস লাগলেই চারা গজাবে। পানির নিচে বাতাস লাগবে না। তবে, ধান ভাঙ্গানোর পর চালের স্বাদ কিছুটা কমে যাবে। ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও সদর উপজেলার প্রায় সকল কৃষকের কাটা ধানে ইতোমধ্যে চারা গজিয়েছে। চারা গজিয়ে উঠা ধান নিয়ে লাখ লাখ কৃষক এখন পড়েছেন বিপাকে। জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের জগদিশপুর গ্রামের কৃষক আজিফর মিয়া বলেন, আমি ৮০ বস্তা ধান পানিতে ফেলেছি। আমাদের মুরব্বিরা আগে এই পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষণ করতেন। আমিও করেছি। তিনি আরও জানালেন, গ্রামের আরও বেশ কিছু কৃষকরা এভাবে ধানের বস্তা পানিতে ফেলেছেন। তবে অনেকেই চারশত/সাড়ে চারশত টাকায় ফড়িয়া বা মিলারদের কাছে বিক্রি করেছে। যদিও ভাল ধানের দাম বাজারে আট থেকে নয় শত টাকা। এ বিষয়ে জগন্নাথপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোঃ শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, কৃষকদের ধান সংরক্ষণের একাধিক পদ্ধতির পরামর্শ দিচ্ছি। প্রচলিত বা সনাতনি পদ্ধতিও বেশ উপকার দেবে। আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলে কৃষকরা ধান রক্ষায় এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। কিন্তু ভোগান্তি কমাতে চাইলে বা স্থায়ী সমাধান চাইলে ধান শুকানোর ড্রায়ার মেশিন কিনতে হবে। কৃষির যন্ত্রপাতি কিনতে সরকার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভতুর্কি দিচ্ছে।
×