ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘দাবায়া রাখতে পারবা না’ মন্ত্রে ছুটে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৩ মে ২০১৮

‘দাবায়া রাখতে পারবা না’ মন্ত্রে ছুটে যাওয়া

গভীর রাত। নির্ঘুম চোখ। অপলক তাকিয়ে থাকা। এত বড় অর্জন! চোখ বুজলেই মিস। দেখা হবে না। বৃহস্পতিবারের মতো শুক্রবার রাতটিও তাই জেগে কাটায় বাঙালী। টেলিভিশন ইউটিউব ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাহেন্দ্রক্ষণ। লাইভ টেলিকাস্ট। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপাড় হতে আনন্দের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল বঙ্গদেশে। সবার ভেতরে শিহরণ। উত্তেজনা। ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান...। উল্টো গণনা শেষ হতেই মাথা উঁচু করে মহাকাশের পানে ছুটে যায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ওয়ান। রাত তখন ২টা ১৪ মিনিট। নতুন যুগের সূচনা করে বাংলাদেশ। সফল উৎক্ষেপণের পর থেকেই বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ। রাতেই যে যার মতো করে উদ্যাপন করেন প্রথম মহাকাশ যাত্রার শুভ ক্ষণটি। ঘরে ঘরে বিজয়ের হাসি। কোন কারণে মস্তিষ্ক উত্তেজিত থাকলে ঘুম আর হয় না। বহু মানুষ বাকি রাতটুকু জেগে কাটিয়েছেন। এমন দেশাত্মবোধ, এগিয়ে যাওয়ার এই যে আকাক্সক্ষা, সত্যি চোখ ভিজিয়ে দেয়। ভেজা চোখেই ঘুমোবার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। শনিবার সকালে সূর্য যথারীতি আলো নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু তারও বেশি আলো ছড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। যারা স্বপ্ন দেখতে জানে না, যারা হতাশার চোরাবালিতে পা দিয়ে আটকে আছে, যারা নিন্দেই করে শুধু তারা আরও একধাপ পেছনে পড়ল। এগিয়ে গেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। এদিন বারবারই মনে পড়ছিল জাতির জনকের কথা। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালীর মহান নেতা বলেছিলেন, ‘দাবায়া রাখতে পারবা না।’ এরপর বহু মৃত্যু। রক্ত গঙ্গা। বাঙালীকে তবু দাবিয়ে রাখা যায়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে নাকে খত দিয়ে বিদায় নিয়েছিল বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। বিজয় পতাকা উড়িয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশও অনেক উত্থান পতনের ঘটনা ঘটেছে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ছিল আমার সোনার বাংলা। কিন্তু তরীটি এখনও থেমে যায়নি। বরং গতি পেয়েছে। জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করছে বঙ্গবন্ধুর ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাংলাদেশের স্যাটেলাইট ক্লাবে প্রবেশ। এখন থেকে বাঙালীর হলো মহাকাশ। হলো মানে, মহাকাশে শুভ সূচনাটুকু হলো। আজ ভাবতে ভীষণ ভাল লাগে যে, অনেক বছর আগেই মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল বাংলাদেশ। স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সেই ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। একেবারেই নতুন চিন্তা হওয়ায় এটি নিয়ে বিরতিহীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার সমস্যা ছিল। সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু থেমে যাননি শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও তারুণ্যের স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করছেন। পরিশেষে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন স্যাটেলাইট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হয় প্রথম স্যাটেলাইটটি। স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের নতুন সংস্করণ ব্লক ফাইভ। ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে বহন করে রওনা হয় জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটের দিকে। রাত ২টা ৪৭ মিনিটে কৃত্রিম উপগ্রহটি নির্ধারিত কক্ষপথে পৌঁছে যায়। বঙ্গবন্ধু ১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হলো। দেশের এই অর্জন এখন নানাভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে। রাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে বড় পর্দায় স্যাটেলাই উৎক্ষেপণের লাইভ টেলিকাস্ট দেখানো হয়। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন। ব্যক্তিগত কম্পিউটার মোবাইল ফোন আছে। এরপরও বড় উপলক্ষ যেহেতু, ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছিল মানুষ। সবাই একসঙ্গে বসে মহাকাশ যাত্রা উপভোগ করেছেন। স্পেসএক্স’র ইউটিউব চ্যানেলে উপচে পড়েছিল ভিউয়ার্স। সেখানে বাঙালীরা নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। অজ¯্র মন্তব্য। কমেন্ট অপশনে বার বার লেখা হচ্ছিল ‘জয় বাংলা/ জয় বঙ্গবন্ধু।’ একাত্তরের যুদ্ধজয়ের কথা আসছিল বারবার। ফেসবুকের নিউজফিড ভেসে যাচ্ছিল আবেগী উচ্চারণে। প্রায় প্রতিটি আইডি ও পেজ থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহূর্তটি শেয়ার করা হচ্ছিল। একই স্থির আলোকচিত্র। অভিন্ন ভিডিও ফুটেজ। কিন্তু বহুবিধ ক্যাপশন। এসব ক্যাপশনে দেশ নিয়ে গর্ব করেছে তরুণ প্রজন্ম। বর্তমান সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করার জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দিত করেছে। খুব প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম। অনেকেই অকারণে অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী পুত্রকে টেনে আনেন। যেখানে সেখানে তার ছবি। পোস্টার হয়ে দেয়ালে লেপ্টে থাকে। পুরনো হয়। আগামী দিনের সম্ভাব্য নেতার নামে যেমন খুশি স্তুতিবাক্য বলেন কর্মীরা। কিন্তু যখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ মহাকাশের পানে ছুটে যাচ্ছে, ঠিক তখন জয় নামটি খুব যৌক্তিকভাবে সামনে আসে। এই বিজ্ঞান মনস্ক তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নেপথ্যে না থাকলে কিছু বড় শুরু বাংলাদেশ করতে পারত না। ফেসবুকে এ কথা লিখে জয়কে উৎসাহিত করতে দেখা যায় অনেককে। তবে ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীতে নয় শুধু, উদযাপন হয়েছে বাস্তবেও। সারা দেশেই ছিল উৎসবের আমেজ। সফল স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আনন্দ র‌্যালি বের করা হয়। বিকেলে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা সমবেত হয়েছিল শাহবাগে। ছুটে এসেছিলেন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন রায়হান। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা এসেছিলেন। কানিজ আকলিমা সুলতানা, এফ এম শাহীন, জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র প্রমুখ একে অন্যকে মিষ্টিমুখ করান। ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন কানিজ তাহমিনা সুলতানা। সবাই মিলে বেলুন উড়িয়ে দেন আকাশে। এভাবে ছোটখাটো কিন্তু চমৎকার উদ্যাপন। আয়োজনে যোগ দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত দুই রাত জেগে কাটিয়েছি। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করছেÑ এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে হবে। দেখেছি। এখানেও সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলাম। আসলে দেশকে ভালবাসলে দেশের অর্জনে যে কারও মন গর্বে ভরে ওঠবে। যাদের সবকিছুতেই নেতিবাচক মনোভাব, যারা সংকীর্ণতায় ভোগেন শুধু তাদের প্রতি করুণাও প্রদর্শন করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আয়োজকদের পক্ষে কানিজ আকলিমা সুলতানা বলেন, আমাদের সমস্যা অনেক। কিন্তু শুধু সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। এগিয়ে যেতে হবে। নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো এগিয়ে যাওয়ার বড় চিহ্ন। আমরা তাই উদ্বেলিত। দেশ নিয়ে গর্ব করতে জানতে হয়। আমরা তাই এখানে সমবেত হয়েছি। আরেক সংগঠক এফ এম শাহীন বলেন, এই অর্জনের দিনে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করছি। তাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মূল মন্ত্র। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে পাওয়া দেশ এগিয়ে যাবেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, উদ্যাপনের আরও বড় বড় উপলক্ষ আসবে বাংলাদেশের জন্য। মহাকাশযাত্রা সবে শুরু হলো। এখন সম্ভাবনার নতুন নতুন দ্বার খুলবে। সব দ্বার খুলে যাক। দৃশ্যমান হোক আগামী দিনের বাংলাদেশ- সকলের তা-ই প্রত্যাশা।
×