ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্য উচ্চতায় দেশ ॥ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সিগন্যাল পৌঁছেছে গ্রাউন্ড স্টেশনে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৩ মে ২০১৮

অনন্য উচ্চতায় দেশ ॥ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সিগন্যাল পৌঁছেছে গ্রাউন্ড স্টেশনে

ফিরোজ মান্না ॥ ফ্লোরিডায় কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের ঠিক ৪০ মিনিট পর গাজীপুরে নির্মিত গ্রাউন্ড স্টেশনে একটি সিগন্যাল আসে। এই সিগন্যালই জানান দিয়েছে স্যাটেলাইটটি সফলভাবে মহাশূন্যে পৌঁছে গেছে। একই ধরনের সিগন্যাল ফ্রান্সের থ্যালাস এ্যালেনিয়া কোম্পানির গ্রাউন্ড স্টেশন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময় ভূমিকা পালনকারী দেশ ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়াও পেয়েছে। মহাকাশ থেকে যে সিগন্যালটি পাওয়া যায় সেটি ছিল ‘টেলিমেট্রি’। স্যাটেলাইটটি যখন ফ্যালকন-৯ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন এ ধরনের সিগন্যাল পাওয়া যায়। এখন অপেক্ষা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে তথ্য পাওয়া। আগামী তিন মাসের মধ্যে স্যাটেলাইট পুরোদমে কাজ শুরু করবে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাকাশে সফল যাত্রায় গোটা জাতি আনন্দ-উল্লাস করেছে। দেশের মানুষ শুক্রবার রাত জেগে নিজেদের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্য দেখেছেন। উৎক্ষেপণের পর উল্লাসে ফেটে পড়েছেন। ইতোমধ্যে স্যাটেলাইটের মালিক দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে সদস্যপদ লাভ করেছে বাংলাদেশ। এখন যে কোন দেশ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে গেলে বাংলাদেশেরও মতামত দেয়ার অধিকার থাকবে। এমন প্রাপ্তি বিগত দিনে খুব কমই অর্জন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও জাতির প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এদিকে বিভাগীয় শহরসহ সারাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশের পথে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য টেলিভিশন সম্প্রচারে দেখেছেন। উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি খুব অল্প সময়ের হলেও স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন তীব্র গতির রকেটে ভর দিয়ে মহাকাশে পৌঁছা বাংলাদেশের স্যাটেলাইট। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে বাংলাদেশ সময় রাত দুটো ১৪ মিনিটে ভূমি ছেড়ে মহাকাশের দিকে দ্রুতগতি নিয়ে ৭/৮ মিনিটের মাথায় মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বহনকারী ফ্যালকন রকেট-৯ ফিরে আসে পৃথিবীতে। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে অবিস্মরণীয় অর্জনের দৃশ্য অনন্তকাল গেঁথে থাকবে বাঙালীর হৃদয়ে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। মহাকাশে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের গৌরবে স্যাটেলাইট এখন উড়ে বেড়াচ্ছে। টানা ৮ দিন মহাকাশে উড়ে নিজ কক্ষপথে স্থাপন হবে। তিন মাসের মধ্যে স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল পাওয়া শুরু হবে। একাত্তর সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের জন্য আরেকটি বিশাল অর্জন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ। এই অর্জনকে জাতি মহাআনন্দ -উৎসাহে বরণ করে নিয়েছে। শুক্রবার গভীর রাত জেগে উৎক্ষেপণের দৃশ্য দেখেছেন জাতি। আনন্দে অনেকে চোখের পানিও ফেলেছেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে মহাকাশ জয়ের দিনটি আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল প্রাপ্তির দিনটি দেশের মানুষসহ বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আবেগে আপ্লুত জাতি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণ খুলে অভিনন্দন জানিয়েছেন। গাজীপুরে গ্রাউন্ড স্টেশনের নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার তাজুল ইসলাম বলেন, কেনেডি স্পেস থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর গ্রাউন্ড স্টেশনে একটি সিগন্যাল পেয়েছি। এই সিগন্যাল প্রমাণ করে মহাশূন্যে স্যাটেলাইট পৌঁছে গেছে। ফ্রান্সের থ্যালাস এ্যালেনিয়া কোম্পানির গ্রাউন্ড স্টেশন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময় ভূমিকা পালনকারী দেশ ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়াও একই সিগন্যাল পেয়েছে। আমরা যে সিগন্যাল পেয়েছি তাকে বলা হয় ‘টেলিমেট্রি’। স্যাটেলাইটটি যখন ফ্যালকন-৯ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন এ ধরনের সিগন্যাল আসে। প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, নেটওয়ার্ক স্থাপন হতে আড়াই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। মহাকাশে নিজ স্থানে স্থাপিত হতে স্যাটেলাইটটির ৭ থেকে ৮ দিন সময় লাগবে। তবে ৭/৮ দিন পর থেকে কিছু কিছু সিগন্যাল আসতে পারে। আবার কোন সিগন্যাল নাও আসতে পারে। তবে আমরা ধারণা করছি কিছু কিছু সিগন্যাল পাব। উৎক্ষেপণের পর নির্ধারিত ৩৩ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পৌঁছে যায়। রকেট উৎক্ষেপণ সংস্থা স্পেসএক্স টুইটারে জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে (জিটিও) স্যাটেলাইটটির অবতরণ নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার (১১ মে) কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯ এ থেকে সফল উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটÑ১। উৎক্ষেপণ শুরু হয় স্থানীয় সময় চারটা ১৪ মিনিটে এবং শেষ হয় ছয়টা ২১ মিনিটে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাহজাহান মাহমুদ ফ্লোরিডা থেকে জানিয়েছেন, উৎক্ষেপণের আগে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বহুবার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। কারিগরি ত্রুটিমুক্ত হওয়ার পরই শুক্রবার গভীর রাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়। এর মধ্য দিয়ে অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারী মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ ই-কে ৫ রকেটে চেপে আকাশে উড়াল দেয় ৩ দশমিক ৭ মেট্রিক টন (সাড়ে তিন হাজার কেজি) ওজনের এই স্যাটেলাইট। রকেটটি মহাকাশে বাংলাদেশের ভাড়া নেয়া অরবিটাল স্লট ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপন হবে। অত্যন্ত সফলভাবে ও নির্দিষ্ট সময়েই স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় আনন্দের খবর। অরবিটাল স্লট ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রীতে পৌঁছাতে স্যাটেলাইটটির ১০-১২দিন সময় লাগতে পারে। অরবিটাল স্লটে সেট হওয়ার পর তা সিগন্যাল পাঠানো শুরু করবে। এখন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে ২৬ কিউ-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার ও ১৪ সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এটি সক্রিয় হলে দেশের টেলিভিশন ও ব্রডব্যান্ড যোগাযোগে উন্নতি ঘটবে। এ স্যাটেলাইটের কারণে তিন ধরনের সেবা ও ৪০ ধরনের সুফল পাবে দেশবাসী। বিটিআরসি জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের থ্যালাস এ্যালেনিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূস্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্বও এই প্রতিষ্ঠানের। তারা তিন বছর গ্রাউন্ড স্টেশন পরিচালনা করবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারই পরে এটি পরিচালনা করবেন। বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশের ২২ ইঞ্জিনিয়ারকে থ্যালাস গত চার বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা এখন গ্রাউন্ড স্টেশনে কাজ করছেন। তারা যে কাজ শিখেছেন তাতে থ্যালাস এখানে না থাকলেও গ্রাউন্ড স্টেশন পরিচালনা করা সম্ভব। তবে আরও বেশি জনবল তৈরি করতে থ্যালাস তিন বছর গ্রাউন্ড স্টেশনে কাজ করবে। স্পেসএক্স তাদের এক টুইটার বার্তায় জানিয়েছে, উৎক্ষেপণের ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড পর রকেট ম্যাক্স কিউতে পৌঁছায়। ২ মিনিট ৩১ সেকেন্ডে প্রথম ধাপে মেইন ইঞ্জিন আলাদা হয়। ২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে দ্বিতীয় ধাপে ইঞ্জিন চালু হয়। ৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে ঘটে ফায়ারিং ডেপ্লয়মেন্ট। ৬ মিনিট ১৫ সেকেন্ড পর প্রথম পর্বের এন্ট্রি বার্ন হয়। ৮ মিনিট ১০ সেকেন্ড পর প্রথম পর্বের অবতরণ, ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড পর দ্বিতীয় পর্বের ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন (এসইসিও-১) হয়। ২৭ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর ২৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে দ্বিতীয় ধাপে ইঞ্জিন বিচ্ছিন্ন (এসইসিও-২) হয়। এরপর ৩৩ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে স্যাটেলাইটটি অরবিটে বা কক্ষপথে অবতরণ করে। স্পেসএক্সের দেয়া তথ্য অনুসারে, পুরো উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ধাপটি কাউন্ট ডাউন ও দ্বিতীয় ধাপটি হচ্ছে লঞ্চ, ল্যান্ডিং ও স্যাটেলাইট ডেপ্লয়মেন্ট। প্রথম ধাপে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শুরু পর্যন্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপটিতে রয়েছে উৎক্ষেপণের পর অবতরণ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়া। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২০টি ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। অন্যগুলো ভাড়া দেয়া হবে। ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রীর অরবিটাল স্লটে (নিরক্ষরেখায়) উড়বে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের জন্য ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১৫ বছরের জন্য অরবিটাল স্লট বা নিরক্ষরেখা (১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রী) লিজ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে এ স্লট বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সঙ্গে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। ১৫ বছরের চুক্তিটি করা হলেও তিন ধাপে তা ৪৫ বছর পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়ানো যাবে।
×