ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সফল হলো স্বপ্ন ॥ সব বাধা কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ১২ মে ২০১৮

সফল হলো স্বপ্ন  ॥ সব বাধা কাটিয়ে  বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

ফিরোজ মান্না ॥ অবশেষে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পালা শেষ। মহাকাশ জয়ের পথে সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস। উৎক্ষেপণ করা হলো বাংলাদেশের গৌরব বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি লঞ্চিং প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৯৭১ সালে বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনের পর সমকালীন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন মহাকাশে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। এই ঐতিহাসিক সাফল্য লাভের মধ্য দিয়ে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিকানাধীন হওয়ার গৌরব অর্জন করল বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত কয়েকবার তারিখ বদলানোর পর শুক্রবার প্রতীক্ষার অবসান হলো। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারী মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স-এর ফ্যালকন-৯ ব্লক-৫ রকেটের চেপে আকাশে উড়াল দেয় সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের এই স্যাটেলাইট। রকেটটি মহাকাশে বাংলাদেশের ভাড়া নেয়া অরবিটার সøট ১১৯.৯ ডিগ্রীতে নিয়ে যাবে স্যাটেলাইটটিকে। উৎক্ষেপণের ৮ দিন পর স্যাটেলাইটটি অরবিটাল সøটে প্রতিস্থাপিত হয়ে সংকেত পাঠাতে শুরু করবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার মহাকাশে উড়তে গিয়েও ওড়েনি বাংলাদেশের গৌরব ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। ‘কাউন্টডাউনে’ ৪২ সেকেন্ডে এসে থেমে যায় বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা। তখন টেলিভিশনের সামনে থাকা কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়ের কম্পনও যেন অনেকটাই থেমে যায়। টেলিভিশনের আলোচকদের মধ্যেও নেমে আসে হতাশার সুর। বৃহস্পতিবার রাত দুটা ১২ মিনিট থেকে চারটা ৪৭ মিনিটের মধ্যে এমন একটি দৃশ্যের অবতারণা হয়। শেষ বেলায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়েছে বলে ঘোষণা আসে। বিটিআরসি জানিয়েছে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বলা হয়েছে, যে কোন রকেট উৎক্ষেপণের এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেই উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়। খোদ আমেরিকার বহু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দিন তারিখ অনেকবার পরিবর্তন করে উৎক্ষেপণের ইতিহাস রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার ‘ব্যাকাপ টাইম’ রাখা হয়েছিল। এই ব্যাকআপ টাইমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। ফ্যালকন-৯ রকেটে ভূমি ছেড়ে টানা ৮ দিন মহাকাশে উড়ে ৩৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিজস্ব কক্ষপথে স্থাপিত হবে স্যাটেলাইটটি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের মালিক দেশ হিসেবে সদস্য পদ লাভ করেছে। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অনেক উঁচুতে। স্পেসএক্স’র আমন্ত্রিত অতিথি রাশেদ রহমান জানিয়েছেন, স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের সবকিছুই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হয়। আবহাওয়াজনিত কিংবা রকেটে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়লে উৎক্ষেপণটিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। খুব বড় কোন ঘটনা না ঘটলেও সামান্য ত্রুটি ধরা পড়লেও উৎক্ষেপণ করা হয় বৃহস্পতিবার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে এমন কিছুই ঘটে। প্রায় ২২ হাজার মাইল দূরে গিয়ে নিজ কক্ষপথে স্থাপিত হবে। তবে হ্যাঁ প্রথম দিন স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ হলে দেশের মানুষের মনে যে আনন্দের বন্যা বইছিল-তা আরও প্রবল হতো। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত নিয়ে বৃহস্পতিবার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তিনি ওই পোস্টে বলেছেন, ‘উৎক্ষেপণের শেষ মুহূর্তগুলো কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। হিসেবে যদি একটুও এদিক সেদিক পাওয়া যায়, তাহলে কম্পিউটার উৎক্ষেপণ থেকে বিরত থাকে। বৃহস্পতিবার যেমন নির্ধারিত সময়ের ঠিক ৪২ সেকেন্ড আগে নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। যেহেতু এই ধরনের বিষয়ে কোন ঝুঁকি নেয়া যায় না, সেহেতু উৎক্ষেপণের মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করা খুবই সাধারণ বিষয়, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’ একই বিষয়ে জয় ইংরেজীতেও পোস্ট দেন। অন্যদিকে, স্পেসএক্স এক টুইট বার্তায় জানায়, শেষ মিনিটে কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ স্থগিত রাখা হয়। রকেট ও স্যাটেলাইট ভাল অবস্থায় আছে। কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, উৎক্ষেপণের ঠিক দুই মিনিট আগে এটি কম্পিউটারের কন্ট্রোলে চলে যায়। স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার হয়তো কিছু সমস্যা ধরে উৎক্ষেপণ বন্ধ করে দেয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ২৪ ঘণ্টার মতো পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে কি সমস্যা হয়েছিল তা জানা যায়নি। কেনেডি স্পেস সেন্টারে থাকা বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে এ রকম বহু ঘটনা আছে। খোদ আমেরিকার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে বহুবার সময় পরিবর্তন করা হয়েছে। যেখানে কাউন্টডাউনের একেবারে শেষ পর্যায়ে গিয়েও উৎক্ষেপণ স্থগিত হতে পারে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এটা কোন বিষয় না। অন্যদিকে স্যাটেলাইট বহনকারী রকেটটি ৭ থেকে ৮ মিনিট দৃষ্টিসীমায় থাকে। এরপর এটি ৩৬ হাজার কিলোমিটার বেগে মহাকাশে কক্ষপথের দিকে এগিয়ে যায়। মহাকাশে ৮ দিন সময় ঘুরে নির্ধারিত স্থানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিজ কক্ষপথে স্থাপিত হবে। বিটিআরসি জানিয়েছে, ৩ দশমিক ৭ মেট্রিক টন ওজন নিয়ে টানা ১৫ বছর অবস্থান করবে। ১৫ বছর চলে যাওয়ার পর স্যাটেলাইট আরও ৩ বছর বার্তা দিতে পারবে। তবে ওই তিন বছরকে ‘লাইভ টাইমের’ ধরা হয়নি। স্যাটেলাইট নির্মাণের এই মহাকর্মযজ্ঞে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিয়েছে এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিদেশী ঋণে নির্মিত হয়েছে। নিজস্ব কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপন করা হবে স্যাটেলাইটটি। গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০ থেকে ২২ দিন সময় লাগবে। গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। দেশের গ্রামাঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা, কেবল টিভি সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম)সহ জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত কাজেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শুক্রবার দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ সরাসরি সম্প্রচার দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকে। দেশের সব জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সাধারণ মানুষকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্য দেখানোর সব আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বীমার আওতায়- বিটিআরসি প্রধান ॥ বিডিনিউজ জানায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বীমার আওতায় থাকায় উৎক্ষেপণে কোন দুর্ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের কোন আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি নেই বলে জানিয়েছেন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির প্রধান শাহজাহান মাহমুদ। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে শুক্রবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘বীমার আওতায় থাকায় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায়িত্ব নেবে স্যাটেলাইটের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তালেস এলিনিয়া স্পেস।’ ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের জন্য সব প্রস্তুতি নেয়া হলেও কাউন্ট ডাউনের শেষ মিনিটে সমস্যা দেখা দেয়ায় রকেট আর ওড়েনি। এ ধরনের মিশনে নানা ধরনের ঝুঁকি থাকায় উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ কতটা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে, সেই আলোচনা চলছে বৃহস্পতিবার রাত থেকে। এই প্রেক্ষাপটে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, বীমা থাকায় বাংলাদেশের কোন আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকবে না, কেবল স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণে বিলম্বের জন্য সময় নষ্ট হবে।
×