ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রার্থীরা দ্বারে দ্বারে, খুলনায় উন্নয়ন ইস্যুতে ভোটের পাল্লা ভারি হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১২ মে ২০১৮

প্রার্থীরা দ্বারে দ্বারে, খুলনায় উন্নয়ন ইস্যুতে ভোটের পাল্লা ভারি হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হচ্ছে উন্নয়ন। মেয়র প্রার্থী থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও নগরীর উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধির অঙ্গীকার নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন তারা। ভোটাররাও ঘরে চুপচাপ বসে নেই। দলীয় ও জোটভুক্ত ভোটারদের ভাবনা নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ঘিরে। কিন্তু নগরীতে বিপুল সংখ্যক ভোটার রয়েছেন যারা কোন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এই ভোটাররাই ভোটের ফলাফলে বিশেষ করে মেয়র পদের প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। উন্নয়ন ইস্যুতে এই শ্রেণীর সচেতন ভোটাররাও প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। মেয়র পদে কোন প্রার্থী যোগ্য, কার দ্বারা নগরবাসীর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে তারাও উন্নয়ন ইস্যুতে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে এক হচ্ছেন, নানাভাবে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করছেন। উন্নয়ন ইস্যুতে ভোটারদের পাল্লা ভারি হচ্ছে। এবার কেসিসি নির্বাচনে ৫ মেয়র প্রার্থী ছাড়া ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪৮ কাউন্সিলর এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৯ কাউন্সিলর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক সড়কের উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা মুক্ত আধুনিক পরিচ্ছন্ন নগর গড়া এবং সর্বাধিক নাগরিক সুবিধার বৃদ্ধিসহ ৩১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের সামনে উপস্থাপন করে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন। বিএনপি মনোনীত ২০ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু গ্রীন সিটি, ক্লিন সিটি গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯ দফা ইশতেহার দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একইভাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মাওলানা মুজ্জাম্মিল হক, সিপিবি মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ এম শফিকুর রহমান নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের ইশতেহারে দফা বা সংখ্যার ক্ষেত্রে কম-বেশী রয়েছে। তবে সকল মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী অঙ্গীকারের মূল সুর হচ্ছে নগরীর উন্নন, নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি করা। উন্নয়ন ইস্যুতে প্রার্থীরা যেমন সরব, তেমনি ভোটাররাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য পাল্লা ভারি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকেও তারা সরব। মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীকে কেন্দ্র করে ভোটারদের হিসাব চলছে। অতীতে কেসিসিতে বিএনপির মেয়র থাকাকালে রাস্তাঘাটের অবস্থা কেমন ছিল, অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রমের অবস্থা কি ছিল, বর্তমান মেয়রের সময়ে নগরবাসী কি অবস্থায় আছেন ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা তালুকদার আব্দুল খালেক মেয়র থাকাকালে নগরীর সড়ক, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ দৃশ্যমান অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা-ের বিষয়টি আলেচনায় উঠে আসছে। রিক্সাচালক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, পেশাজীবীসহ সর্বমহলে নগরীর অতীত বর্তমান নিয়ে তুলনা চলছে। নগরীর ২৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি খুলনা শহরে ৩০ বছরের অধিক রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মেয়র তৈয়েবুর রহমানের সময়ে রাস্তাঘাট ছিল খানাখন্দে ভরা। রিক্সা চালাতে খুব কষ্ট হতো। যাত্রীরা ভয়ে ভয়ে রিক্সায় চলতেন। কখন রিক্সা উলটে যায় এই আতঙ্কে থাকতেন। তালুকদার খালেক মেয়র হওয়ার পর রাস্তা চলাচল উপযোগী হয়। তখন রিক্সা চালিয়ে শান্তি পেয়েছি। গত কয়েক বছরে আবার রাস্তার যে হাল হয়েছে তাতে রিক্সা চালাতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। তিনি বলেন, নগরীর উন্নয়নে তালুকদারের (খালেক) মতো লোক দরকার। এক নাগরিক নেতা বলেন, তালুকদার আব্দুল খালেকের বিরোধীরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, খালেক সাহেবের সময়ে নাগরিক সেবার যে মান বেড়েছিল, উন্নয়নের পথে তিনি যেভাবে খুলনাকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ছিলেন তার সুফলভোগীও কিন্তু ওই খালেক সমালোচকরা। খালিশপুরে ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক মুজিবর রহমান জানান, বিএনপির সময়ে এখানকার পিপল্স ও দৌলতপুর জুটমিল বন্ধ করে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই পাটকল দুটি চালু করে। পাটকল শ্রমিকদের এখনও অনেক সমস্যা আছে। বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া ছিল। কিছুদিন আগে পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া বাবদ ৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই পাওনা পেতে খুলনা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেন-দরবার করেছেন। এই শ্রমিকদের ভোট নিশ্চয়ই নৌকা প্রতীকের পক্ষে যাবে বলে তিনি মনে করেন। ২৭ নং ওয়ার্ডের নতুন ভোটার ইমরান হোসেন বলেন, পরিবারের বড়দের নিশ্চই একটা ভাবনা চিন্তা থাকবে। এখনও এনিয়ে অভিভাকদের সঙ্গে কথা হয়নি। তবে সৎ, যোগ্য, নিষ্ঠাবান প্রার্থী, যার দ্বারা শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যা দূর হবে, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হবে, যানজটের সমস্যা দূর করা সম্ভব, সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে, এমন পরীক্ষিত প্রার্থীকেই ভোট দেবেন তিনি। জনগণের ওপর আস্থা না থাকায় বিদেশী পর্যবেক্ষক চায় বিএনপি- খালেক ॥ কেসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ও ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আলহাজ তালুকদার আব্দুল খালেক শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮ টায় নগরীর ১৯ নং ওয়ার্ডেও খলিল চেম্বার এলাকা থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। এরপর তিনি গোবরচাকা, তেঁতুল তলা, স্টাফ কোয়ার্টার, পল্লী মঙ্গল, পৈপাড়া, বিস্মিল্লাহ্ মহল্লা, বি কে রায় রোড সংলগ্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন, ভোটারদের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, দেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে বিদেশী পর্যবেক্ষক চাইছেন বিএনপি মেয়র প্রার্থী। বিএনপি এখন জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়েছে, এজন্য সাধারণ মানুষের ওপর তাদের আস্থা নেই। বিদেশী পর্যবেক্ষক দাবি করে বিএনপি আবারও সিটি নির্বাচনকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছে। তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, খুলনা সিটিতে দীর্ঘদিন বিএনপির মেয়র থেকেও নগরীর উন্নয়ন করতে পারেনি। জনগণ এবারের নির্বাচনে বিএনপির চলমান মিথ্যাচার, অপকৌশল ও দুর্নীতির জবাব দেবে। মেয়র প্রার্থী খালেক আরও বলেন, খুলনার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট আন্তরিক। তার আন্তরিকতায় খুলনাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নকাজ সাধিত হয়েছে। খুলনার উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে আসন্ন সিটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীককে ভোট দিয়ে নগরবাসীকে কাক্সিক্ষত সেবা প্রদানের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। গণসংযোগকালে মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে ছিলেন জাসদ খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি ও ১৪ দল নেতা রফিকুল হক খোকন, নগর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হায়দার আলী, জাহাঙ্গীর হোসেন খান, সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বুলু বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক তসলিম আহমদে আশা, সহ-সভাপতি শাহজাহান পারভেজ, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদুল হক, সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী হাজী মোতালেব মিয়া, যুবলীগ নেতা এস এম হাফিজুর রহমান হাফিজ প্রমুখ। আওয়ামী লীগ পুলিশ লেলিয়ে ধানের শীষের বিজয় ছিনিয়ে নিতে চায়- মঞ্জু ॥ কেসিসি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ও ২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু শুক্রবার সকালে নগরীর সোনাডাঙ্গা ময়লাপোতা হরিজন পল্লী থেকে গণসংযোগ শুরু করেন। এরপর নিউ মার্কেট কাঁচা বাজার, বানরগাতি বাজার, ইসলাম কমিশনারের মোড়, সোনাডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড ও সংলগ্ন এলাকায় গণসংযোগ, কুশল বিনিময় ও লিফলেট বিতরণ করেন। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ধা০েনর শীষের বিজয় ছিনিয়ে নিতে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট, ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বশীল নেতাদের গ্রেফতার করেও আমাদের বিজয় ঠেকানো যাবে না। কোন ধরনের হুমকি ও ভীতির কাছে বিএনপির কর্মীরা নতি স্বীকার করবে না। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, বিজেপি নেতা এ্যাডভোকেট লতিফুর রহমান লাবু, সিরাজউদ্দিন সেন্টু, জামায়াত নেতা এ্যাডভোকেট শাহ আলম, বিএনপি নেতা ফখরুল আলম, অধক্ষ তারিকুল ইসলাম প্রমুখ। বিদেশী পর্যবেক্ষক আসার আহ্বান ॥ এর আগে সকাল ৮টায় নগরীর মিয়াপাড়ার বাসভবনে এক প্রেসব্রিফিংয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু নেতাদের গ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশির অভিযোগ করে বলেন, কেসিসি নির্বাচনে পুলিশী নির্যাতন অপ্রচারের মাধ্যমে সরকারের আসল চেহারা ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, প্রতিদিন আমাদের মিছিল বড় হচ্ছে, জমায়েত বড় হচ্ছে। এটা সরকারের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার ২৫ নং ওয়ার্ডে কর্মসূচী শেষে ৩ জন এবং রাতে ১৭ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে এবং ৫ শতাধিক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের সন্ত্রস্ত করা হয়েছে। তিনি সকল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও ঢাকা থেকে জাতীয় সকল পর্যবেক্ষক সুধী সমাজকে খুলনায় ভোট পর্যবেক্ষণ করতে আসার জন্য আহ্বান জানান।
×