ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শ্রদ্ধা ভালবাসায় মুস্তাফা নূরউল ইসলামের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১২ মে ২০১৮

শ্রদ্ধা ভালবাসায় মুস্তাফা নূরউল ইসলামের চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা ভালবাসায় চিরবিদায় নিলেন জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। শুক্রবার সমাহিত করা হলো বাঙালিত্বের চিন্তা ও চেতনার প্রতীকে পরিণত হওয়া এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে। বিদায়যাত্রায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সিক্ত হয়েছেন ভালবাসায়। এই কীর্তিমানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন কবি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিনয়শিল্পী, নাট্যজনসহ নানা শ্রেণীরপেশার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইদফা জানাজা শেষে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। আগামী সোমবার বাংলা একাডেমির আয়োজনে তার স§রণে নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে। বেলা ১১টায় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় মুস্তাফা নূরুল ইসলামের শবদেহ। রাখা হয় মিনারের উল্টো পাশের শিরীষ বৃক্ষতলে। ভক্ত-অনুরাগী ও শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকে আগে থেকেই হাতে ফুল নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন শ্রদ্ধা নিবেদনে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে ব্যক্তিগতভাবে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, সরকারী কর্ম কমিশনের সচিব আখতারী মমতাজ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কবি মুহাম্মদ সামাদ, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, ম হামিদ, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, কবি কামাল চৌধুরী, ড. ইনামুল হক, কবি নাসির আহমেদ প্রমুখ। আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে আরও শ্রদ্ধা জানায় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, ছায়ানট, উদীচী, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, এটিএন বাংলা, মহিলা পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সরকারী সঙ্গীত কলেজ, থিয়েটার। সবশেষে সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফের নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বড় ছেলে মুস্তাফা ইমরুল কায়েস বলেন, বাবা বলতেন, কখনই পিছনে ফিরে তাকাবে না, সামনের দিকে তাকাবে। এ সময় তিনি তার বাবার বই ও গবেষণাপত্রগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, তাকে তিনি একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানতেন। কোন জায়গায় কথা বলতে হলে সাবধানতা অবলম্বন করতেন। কখনও লিখে আনতেন, লিখে না আনলেও বক্তব্যের আগে কিছু লিখতেন, তা অনুসরণ করে তিনি বক্তব্য দিতেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতেন। তিনি উৎকর্ষের চেষ্টা করতেন সব সময়, কিছু একটা করলে তার উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করতেন। বলা যায়, তিনি তার জীবনটি উৎকর্ষভাবেই যাপন করেছেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সাহিত্য-সংস্কৃতির বরপুত্র। সংস্কৃতির সব শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। তিনি যা লিখে গেছেন, তাতে তার সততা, প্রতিভা আর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। রাশেদ খান মেনন বলেন, বাঙালীর প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ও মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন এই মহীরুহ। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশেও ভূমিকা পালন করেছেন। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এ দেশ সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের এক মহীরুহকে হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ বা বাঙালী চেতনার কথা যদি বলি, তবে সারা জীবন সে চেতনা লালন করেছেন, সৃজনকর্মে তিনি তা তুলে ধরেছেন বারবার। বিগত কয়েক মাস ধরে আমরা অভিভাবক হারাচ্ছি। এর ফলে একটি শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। যা পূরণের দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। আলী যাকের বলেন, কখনও গম্ভীর মুখে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তার সান্নিধ্যে মনটা উজ্জ্বল হয়ে যায়। ভাষা সংক্রান্ত যে কোন সমস্যায় তার শরণাপন্ন হওয়ায়, তিনি নির্দ্বিধায় সাহায্য করেছিলেন। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের মনে হয় মৃত্যু নেই, তিনি তাদেরই একজন। শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত স্বল্প সময়ে তিনি গবেষণাকর্মে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাঙালী মুসলমানের বাঙালী হয়ে উঠার সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন আমৃত্যু। তুলে ধরেছেন বাঙালীর বিবর্তনের ইতিহাস। রামেন্দু মজুমদার বলেন, তিনি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি বাঙালিত্বের পরিচয়ে বলীয়ান হতে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, তরুণ বয়সে তিনি যেমন নির্ভীক ও সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, পরিণত বয়সে এসেও তিনি একই ভূমিকা রেখেছেন। মৌলবাদের উত্থান ও স্বৈরশাসনের বিপরীতে তার আদর্শ আমাদের অনুসরণীয়। দীর্ঘদিন এটিএন বাংলায় তিনি ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন। সেই প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে এটিএন বাংলার উপদেষ্টা নওয়াজেশ আলী খান বলেন, জনপ্রিয় এ অনুষ্ঠানে ৮০০ পর্ব প্রচারিত হয়েছে। প্রতিটি পর্বেই তিনি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। যেখানে আমরা ১০ থেকে ১২টি বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি না, সেখানে তিনি এতগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটা শুধু মুস্তাফা নূরউল ইসলামকে দিয়েই সম্ভব। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন। কথা ছিল, যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন এই অনুষ্ঠান করে যাবেন। শহীদ মিনার থেকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের বিশেষ সংরক্ষিত স্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর বাঙালীর ভাষা অধিকার রক্ষার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বুধবার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজ বাসভবনে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। এর পর থেকে তার মরদেহ রাখা হয়েছিল এ্যাপোলো হাসপাতালের হিমঘরে। সেখান থেকে শুক্রবার সকালে তার মরদেহ গুলশান আজাদ মসজিদে গোসল করিয়ে নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় তার নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠিত হয়। শোকসভা : বাংলা একাডেমির প্রথম মহাপরিচালক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্মরণে আগামী ১৪ মে বিকেল সাড়ে ৪টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে শোকসভার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
×