ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প

স্বপ্নের বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশেই স্বপ্নের আবাসন ॥ ওরা ভুলে গেছেন পিতার ভিটেমাটি হারানোর বেদনা

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১২ মে ২০১৮

স্বপ্নের বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশেই স্বপ্নের আবাসন ॥ ওরা ভুলে গেছেন পিতার ভিটেমাটি হারানোর বেদনা

রশিদ মামুন/মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ আন্ধারমানিকের দখিনা হাওয়া এসে ছুঁয়ে যায় মন। এ অন্যরকম এক শান্তি। এখানে এলে আগে হারানোর ব্যথায় হু হু করে উঠত বুকটা। এখন চোখ জুড়ানো প্রশান্তি এনে দেয়। কোনদিন যা কেউ ভাবেননি পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের আবাসন প্রকল্পে, ঠিক তাই যেন হচ্ছে। আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে বসতভিটা হারানো আবুল খায়ের বলছিলেন কথাগুলো। তিনি বলছিলেন, আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি এমন এক পরিকল্পিত আবাসনে থাকার সুযোগ পাব। এমন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, পাকা রাস্তা, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, পুকুর, স্কুল সবই তৈরি হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে আগামী জুনেই আবাসন প্রকল্পটির ঘরগুলোতে উঠতে পারবেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা। অনেকের মতো জাকির সরদার তো দিনই গুনছেন। কবে ফিরবেন নিজের ঘরে। কবে ফিরবেন নিজের বাড়ি। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঘর-বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। পটুয়াখালীতে ঘর ভাড়া করে আছেন এখনও। কিন্তু এখন তো ফেরার পালা। ফিরতে চান তিনি। ফিরতে চান নিজের বাড়ি। চেনা গ-িতে পরিচিত মুখেদের ভিড়ে। জাকির সরদার এখন খুশি। খুব খুশি। পিতার ভিটে হারানোর বেদনা আর তাড়া করে না। বরং তার চেয়ে উন্নত জীবন পাবার প্রত্যাশায় রয়েছেন বলে জানালেন তিনি। পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন প্রকল্পটি। বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য যারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদেরই রাখা হবে আধুনিক এই গ্রামে। আবাসন প্রকল্পের কাজটি একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। ঘরগুলোর ভেতর-বাইরের কাজ শেষ। এখন মসজিদ আর স্কুলের সামান্য কিছু কাজ বাকি রয়েছে। পুকুরঘাট সিঁড়ি বাঁধানো। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সংযোগও দেয়া হয়েছে। এখন শুধু হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাকি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার ২০১৬ সাল থেকে বাড়িঘর ছেড়ে শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। এক সময় উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল এদের, এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের ঘরটিতে অবস্থান করে স্থায়ী মালিকানার বাস্তবতার স্বাদ পেতে যাচ্ছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া মৌজার ১৩০ পরিবার আগামী জুনে নির্মাণ কাজ শেষে তাদের ঘর বুঝে পেয়ে কষ্টের অবসান ঘটানোর অপেক্ষার শেষ প্রহর গুনছেন। এসব পরিবারে যেন আর তর সইছে না। এখন এই পুনর্বাসন পল্লী দূর থেকে দেখে যে কারও স্বাদ জাগে বসবাসের। সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৬ একর জমির ওপর এই পুনর্বাসন পল্লীর প্রায় সব ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ। এখন চলছে ফিনিশিং পর্যায়ের কাজ। বিদ্যুতের সংযোগ দেয়ার কাজও চলছে। দুটি ডিজাইনে করা হয়েছে এই সেমিপাকা ঘরগুলো। যেসব পরিবারের ২০ শতকের বেশি জমির বসতি নষ্ট হয়েছে তাদের জন্য সাড়ে সাত শতক জমিতে ১২ শ’ বর্গফুট আয়তনের ৮২টি এবং যাদের কম ক্ষতি হয়েছে তাদের জন্য সাড়ে পাঁচ শতক জমিতে এক হাজার বর্গফুট আয়তনের ৪৮ টি ঘর করা হয়েছে। সব ঘর এল টাইপের। দক্ষিণমুখো। ঘরের প্রত্যেকটিতে ১৫ দশমিক সাত ফুট আয়তনের বাথরুম, একটি মাস্টার বেডরুম ছাড়াও দুটি ১৫ ফুট আয়তনের বেডরুম রয়েছে। ১০ দশমিক চার ফুট আয়তনের একটি ডাইনিং রুম। ১২ দশমিক দুই ফুটের রান্নাঘর। এছাড়া একটি কমন বাথরুম রয়েছে। সামনের বারান্দা লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো রয়েছে। প্রত্যেকটি ঘরের সামনে একটি খালি জায়গা থাকছে যেখানে শাক-সবজির আবাদ কিংবা গবাদিপশুসহ হাঁস-মুরগি পালনের সুযোগ থাকছে। পুনর্বাসন পল্লীতে ৩৬ হাজার ৯২৯ এবং ২৪ হাজার ৫৫৪ বর্গফুট আয়তনের দুটি পুকুর খনন করা হয়েছে। যার উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রশস্থ সান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। পাশে রাখা হয়েছে বেঞ্চ। এই পল্লীতে নিরাপদ পানির জন্য ৪৮টি গভীর নলকূপ খনন করা শেষ পর্যায়ে। আধুনিক দ্বিতল মসজিদের কাজ শেষ পর্যায়ে। ২৩ শতক জমিতে করা হয় মসজিদটি। দ্বিতল কমিউনিটি সেন্টারের এখন দেয়ালের গাঁথুনি ছাড়া সব সম্পন্ন হয়েছে। এর নিচতলায় থাকবে ক্লিনিক। ৪০০ বর্গমিটার আয়তনের এই কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। রাখা হয়েছে খেলার মাঠ। চারটি দোকান করার মতো স্পেস নিয়ে একটি শপিং সেন্টার করা হয়েছে। রয়েছে ঈদগাঁ মাঠ। একটি স্কুল ভবন করা হয়েছে। যেখানে কারিগরি শাখার অগ্রাধিকার থাকছে। ভেতরের পানি নিষ্কাশনের সাড়ে চার কিমি ড্রেনসহ ১২ ফুট প্রস্থ দুই দশমিক সড়ক করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট কবরস্থান করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিএ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জুন মাসে এই পুনর্বাসন পল্লীর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া এখনই চলছে। দূর থেকে দেখা এই পল্লী এখন নজরকাড়ে অন্যদেরও। সর্বক্ষণিক বিদ্যুত সুবিধা থাকছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুত সংযোগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আবাসনের সুবিধা পাবেন যারা তাদেরই একজন রোজা তালুকদার। বললেন এক কোটি টাকা পেয়েছি ক্ষতিপূরণ বাবদ। সেই টাকায় খেপুপাড়ায় একটি বাড়ি করেছি। আর পোস্ট অফিসে বাকি টাকা রেখেছি। আরও এক কোটি টাকা পাবেন বলে আশা করছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের এভাবে বাড়িঘর করে দেয়া হবে, তা তিনি ভাবেননি। অভাবনীয় বিষয়টি সত্যি হয়ে যাওয়ায় সকলের মতো তিনিও ভীষণ খুশি। নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, এখান থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুত বিক্রি থেকে দশমিক তিন পয়সা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জীবনমানের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এখানের কারিগরি স্কুলে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ দেয়া হবে। ফলে শুধু থাকা নয়, জীবন চালানো নিয়েও কোন চিন্তা থাকবে না। আবুল কালাম মাস্টার জানান, দুই বছর বাড়িঘর, জমিজমা হারিয়ে মানবেতর কষ্ট করেছি। এখন পুনর্বাসনের পল্লীর কাজ সম্পন্ন হতে দেখে স্বস্তি এসেছে মনে। তবে তার পরামর্শ, এ পল্লীর সঙ্গে মূল ওয়াপদা সড়কের সংযোগ সড়কটি দ্রুত করা প্রয়োজন। এছাড়া এখন কর্মহীন, বর্ষকাল। শুকনো মৌসুমে পল্লী উদ্বোধন করলে সবার সুবিধা হতো। এছাড়া তার দাবি, পল্লীর বাসিন্দাদের দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানও করতে হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের সিএমসি নির্মাণ করছে। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিসিপিসিএল) নামের একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। আমদানি করা কয়লাতে কেন্দ্রটি চালানো হবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রের ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, মানুষ তার ভিটে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারে না। এই বোধ থেকেই আমারা এই আধুনিক গ্রাম তৈরির উদ্যোগ নেই। এখানে শুধু মানুষের আবাসনের ব্যবস্থাই হবে না। তাদের মধ্যে যোগ্যদের বিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ দেয়ার ব্যবস্থাও করা হবে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তানভীর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের যথাযথভাবে দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
×