ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দশ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা আগে মিলবে সতর্কবার্তা

বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত দেবে ডিটেকটিভ সেন্সর

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১২ মে ২০১৮

বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত দেবে ডিটেকটিভ সেন্সর

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ কোন্ এলাকায় বিজলি চমকাবে এবং বজ্রপাত হবে তার আগাম সঙ্কেত দেয়া শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঝড়-বৃষ্টির সময় কোন্ জেলায় বজ্রপাত হতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে আবহাওয়া অফিস। এমনকি ১০ মিনিট থেকে আধাঘণ্টা আগে বজ্রপাতের সঙ্কেত দেয়া যাবে। এতে ওই এলাকার মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার সময় পাবে। ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমে আসবে দেশে। বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত জানতে ইতোমধ্যে দেশের আটটি স্থানে বসানো হয়েছে লাইটেনিং ডিটেকটিভ সেন্সর। স্থানগুলো হচ্ছে বরিশালের পটুয়াখালী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, নওগাঁর বদলগাছি, ময়মনসিংহ, সিলেট ও খুলনার কয়রা। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটটি সেন্সরে পুরো দেশের চিত্র উঠে আসবে। একেকটি সেন্সরের রেঞ্জ ২৫০ কিলোমিটার। প্রতিটি সেন্সর থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত মনিটরিং করা যাবে। এক মৌসুমে (এপ্রিল থেকে জুন) দেশে কতবার বিদ্যুত চমকায় এবং বজ্রপাত হয় সেটিও সংরক্ষণ করা হবে। তবে এখন সব চলছে পরীক্ষামূলকভাবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হবে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা বলেন, রেডিও, টেলিভিশন, ওয়েবসাইটে এখনও বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়। তবে সেটি রাডার থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেয়া হয়, যাতে বজ্রপাতের চিত্র সুস্পষ্টভাবে আসে না। এছাড়া এখন বজ্রপাতের তথ্য দেয়া হয় জেলাওয়ারি। কিন্তু ডিটেকটিভ সেন্সরের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এলাকার নামও বলা যাবে। কর্মকর্তারা আরও বলেন, আগে বজ্রপাতের প্রতি নজর ছিল কম। গুরুত্ব অনুধাবন করে এখন এর প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ যদি সচেতন না হয়, সঙ্কেত পাওয়ার পরও যদি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা না ছাড়ে তাহলে কোন উদ্যোগই কাজে আসবে না। আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৩টি নদীবন্দরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাতের সঙ্কেত ও সংখ্যা নিরূপণের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আটটি ডিকেটটিভ সেন্সরের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক মজিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখন পরীক্ষামূলকভাবে ডিটেকটিভ সেন্সর ব্যবহার করছি। কোথায় কোথায় ত্রুটি বিচ্যুতি হচ্ছে সেটি দেখা হচ্ছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি চালু হবে। তখন বজ্রপাতের সঙ্কেত আগাম দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়া বজ্রপাতের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। একইসঙ্গে বিদ্যুত চমকানোর তথ্যও থাকবে। কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানান, চারভাবে বজ্রপাত হয়ে থাকে। প্রথমত, মেঘমালা থেকে ভূপৃষ্ঠে। দ্বিতীয়ত, মেঘমালার সঙ্গে মেঘমালা। তৃতীয়ত, একই মেঘের মধ্যে। চতুর্থত, মেঘমালা থেকে বায়ুমণ্ডলে। এর মধ্যে মেঘমালা থেকে ভূপৃষ্ঠে যে বজ্রপাত হয় সেটি সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। তাতে মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আবহাওয়া কর্মকর্তা বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, অনেক বজ্রপাত হয় ভূপৃষ্ঠের ওপর, যেটা ক্ষতিকর নয়। যেটি ভূপৃষ্ঠে পড়ে সেটি ক্ষতিকর। মানুষের মৃত্যু হয়। নতুন ডিটেকটিভ সেন্সরের মাধ্যমে জানা যাবে একদিনে কতবার বিজলি চমকায় এবং কতবার বজ্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বছর আগেও বজ্রপাতে বছরে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন মানুষ মারা যেত। প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বাড়ায় সেখানে মৃতের সংখ্যা কমে ২০-এ দাঁড়িয়েছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, কানাডা এমনকি পাশের দেশ ভারতেও ডিটেকটিভ সেন্সর বসিয়ে বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত মিলছে। উল্টোদিকে বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। সূত্র মতে, এ বছর পহেলা বৈশাখ থেকে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে অর্ধশতাধিক লোক মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে। হাওড়াঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে বজ্রপাতে। বজ্রপাতের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাত বাড়ছে। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাত হচ্ছে এটা বলার সময় এখনও আসেনি। তিনি বলেন, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। ঘর ছেড়ে বাইরে আসার প্রবণতাও বাড়ছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মব্যস্ত। আগে অনেক কৃষিজমি খালি পড়ে থাকত। এখন সেসব জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষ কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে। তাছাড়া আগে দেশের প্রায় সব স্থানে বড় বড় গাছ ছিল। সে সব গাছও কমে গেছে শিল্পায়নের কারণে। জলাভূমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এসব কারণে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে সারাদেশে তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু সে উদ্যোগেও গতি নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, আমরা ২৮ লাখ বীজ লাগিয়েছি। তালগাছ হতে কিছুটা সময় লাগে। আমরা গাছ লাগানোর যে উদ্যোগ নিয়েছি, সেটি সফল হবে। তবে কিছুটা সময় লাগবে। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা, বাতাসে সিসার পরিমাণ, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছ কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া বজ্রপাতের কারণ। এছাড়া বিল্ডিং কোডে ১০ তলা পর্যন্ত ভবনে বজ্রপাত প্রতিরোধ রড ব্যবহার করার কথা থাকলেও রাজধানী ঢাকা ছাড়া অন্য কোনস্থানে তা মানা হচ্ছে না।
×