ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৮৪ এতিম মেয়ের মা

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১২ মে ২০১৮

৮৪ এতিম মেয়ের মা

সচরাচর একজন জেলা প্রশাসক একটি সংযত, বাঁধা-ধরা জীবন যাপন করে থাকেন। কিন্তু নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের জীবনের গল্পটা একটু অন্য রকম। যে কেউ এটা শুনে বিস্মিত হবেন যে, একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দিঘাপতিয়া বালিকা শিশু সদনে’র ৮৪জন এতিম মেয়ে জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে থাকে। এবং এটি শুধু নিছক কোন সম্বোধন নয়। মাতৃ স্নেহ, আদর-ভালবাসা দিয়ে, জীবন গঠনে সহায়ক বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে অনুপ্রাণীত করে চলেছেন বলেই সত্যিকার অর্থেই যেন তিনি এই অনাথ শিশুদের মা’য়ের স্থান দখল করে নিয়েছেন। মমতাময়ী শাহিনা খাতুনও তাদেরকে নিজের সন্তানের মতই দেখেন, যেমনটি তিনি তার দুই মেয়ে তাহিয়া আনান ধীরা ও কাসফিয়া আজিজ প্রাচীর ক্ষেত্রে ভাবেন। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে তিনি তাদের পোশাক, সাজসজ্জা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেন। নাটোর উত্তরা গণভবনের সামনেই দিঘাপতিয়া বালিকা শিশু সদন অবস্থিত। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই এতিমখানার যাত্রা শুরু হয় সমাজের সচেতন মানুষের চাঁদা, সাহায্য-সহযোগিতার টাকায়। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের তহবিল থেকে আসা অনুদান-অর্থে আরো গতি পায় এতিমখানাটি। ১৯৯৫ সালে সমাজ কল্যাণ অধিদফতরের অধীনে রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। এখানে ১ থেকে ১৮ বছরের শিশু-বালিকা ও কিশোরীরা লেখাপড়া করে। ১৮ বছরের বেশি বয়স হলে কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া, জীবন প্রতিষ্ঠিত হতে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করে আসছে কর্তৃপক্ষ। চলতি বছর এই এতিমখানা থেকে ১০জনের মধ্যে ৯জন এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৬সালে জেলা প্রশাসক হিসেবে নাটোরে বদলি হয়ে আসার পর শাহিনা খাতুন দিঘাপতিয়া বালিকা শিশু সদনের সামগ্রিক দৃশ্যপট পাল্টে ফেলার পরিকল্পনা হাতে নেন। তার মধ্যে এইসব এতিম শিশুদের ভবিষ্যতে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি পর্যায়ক্রমে ট্রেনিং সেন্টার, বাইন্ডারি ওয়াল, ডাইনিং, বিছানাপত্রসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করে চলেছেন। এক কথায় এতিম খানার সকল বাচ্চা-শিশু-কিশোরীরা মা বলতে এখন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনকেই বোঝেন। তিনি প্রশাসনিক কাজের ফাঁকে সময় যখনই সময় পান, এতিমখানায় এসে শিশু-কিশোরীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যান। এ সময় তিনি তাদের বাস্তব জীবনের নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যেতে নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। দিঘাপতিয়া শিশু সদনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আলী মুকুল জানান, একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে অন্যের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এতগুলো এতিম বাচ্চাদের লালন-পালন করা অনেক কঠিন। এর পরেও যতটা সম্ভব বিভিন্ন ধরনের সেবা-সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মধ্য দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন নাটোরে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে যোগদানের পরেই এই এতিম খানাটি তার নজরে এলে তিনি মাতৃ স্নেহ বিলানো শুরু করেন। এক পর্যায়ে এখানকার সকল শিশু-কিশোরী তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন জানান, গত ৩০ বছরে আমি ২০জন জেলা প্রশাসককে দেখেছি। কিন্তু তাদের মধ্যে শাহিনা খাতুন অসাধারণ চরিত্রের অধিকারিণী। তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করেন। তিনি আমলাতান্ত্রিক ব্যবহার কখনই তার মধ্যে দেখা যায় না। লাঠি বাশি সংগঠনের সভাপতি আব্দুস সালাম জানান, শাহিনা খাতুনের মতো একজন জেলা প্রশাসক পেয়ে আমরা গর্বিতবোধ করি। জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, আমি আমার দুই মেয়েকে সবসময় বলি, আমার বাসার কাজের মেয়ে চাঁদনী খাতুন ছাড়াও আমার আরও ৮৪জন মেয়ে আছে। একজন মানুষের পক্ষে এতবেশি কিছু করা সম্ভব নয়। তবে এতিমদের জন্য কিছু করার সুযোগ পেলে তিনি তৃপ্তি লাভ করেন। এই এতিমখানাটিকে টিকিয়ে রাখতে যা করা দরকার তা নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এই বাচ্চাদের জন্য আমরা কিছু না করলে এরা যাবে কোথায়? -কালিদাস রায়, নাটোর থেকে
×