ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১২ মে ২০১৮

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

(গতকালের পর) স্বপ্নের মেট্রোরেল রাজধানীর যানজট নিরসন এবং স্বস্তিদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বর্তমানে রাজধানীতে যানজট এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, ৩০ মিনিটের যাত্রাপথ তিন-চার ঘণ্টায়ও অতিক্রম করা যায় না। কখনও কখনও পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যানজটের কারণে রাজধানীবাসীর যে বিপুল কর্মঘণ্টা ও অর্থ অপচয় হয়, তা বলাই বাহুল্য। ঢাকা মহানগরীর জনগণের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসানে সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায়(এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে তিনটি রুটে মেট্রো রেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো, উত্তরা-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-খিলগাঁও হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত, গুলশান-মিরপুর-মোহাম্মদপুর-ধানমণ্ডি-তেজগাঁও-রামপুরা-বাড্ডা-বারিধারা হয়ে গুলশান পর্যন্ত এবং উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে পল্লবী হয়ে রোকেয়া সরণি-খামারবাড়ী-ফার্মগেট-হোটেল সোনারগাঁও-শাহবাগ-টিএসসি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এর মধ্যে শেষের রুটটিতে মেট্রো রেল স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ২০১৯ সাল নাগাদ এ রুটেই চলাচল করবে স্বপ্নের সেই ট্রেন। বর্তমানে অবিরাম চলছে পরীক্ষামূলক পাইলিং, ডিপো ও স্টেশন নির্মাণ কাজ। ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের প্রথম স্প্যান ও দৃশ্যমান। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে দুটি পিলারকে যুক্ত করে এই স্প্যানটি বসানো হয়েছে। শীঘ্রই আগারগাঁও এলাকার দুটি পিলারের ওপর আরেকটি স্প্যান বসানো হবে। আগামী বছর ডিসেম্বরের আগেই মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরা থেকে স্বল্প সময়ে মতিঝিলে পৌঁছা যাবে। উত্তরা হয়ে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর রুট হবে মতিঝিল পর্যন্ত। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ লাইনে স্টেশন থাকবে ১৬টি। প্রতি চার মিনিট পরপর এক হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল। প্রতি ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহন করবে প্রায় ৬০ হাজার। ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো। মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এবং সাতটি স্টেশন নির্মাণের কাজও শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে। মেট্রোরেল চালু হলে অন্যান্য গণপরিবহনে যাত্রীর চাপ কিছুটা কমবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মেট্রোরেল যুগে প্রবেশের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রার সূচনা করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের অপেক্ষায়। আজ ১২ মে শুক্রবার রাতে অরল্যান্ডোর কেনেডি স্পেসএক্স সেন্টারে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ চালানোর কথা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাঙালীর এই স্বপ্নযাত্রার অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে। দেশের প্রথম এ কৃত্রিম উপগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে মহাকাশের উদ্দেশে উৎক্ষেপণ করা হবে। স্যাটেলাইটটিতে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এই কৃত্রিম উপগ্রহ, স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০ ধরনের সেবা দেবে। স্যাটেলাইটটি চালু হলে দেশের ৩৭টি টিভি চ্যানেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে বছরে প্রায় ১২৫ কোটি ডলার আয় হবে। এসব চ্যানেল এখন বিদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে ফ্রিকোয়েন্সি কিনে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ট্যারিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা, পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ই-সেবা নিশ্চিত করবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটটির সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন সরকারি ও বেসরকারী খাতে দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৭৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। নতুন করে ৯টি যোগ হলে স্থান নির্বাচন হওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৮ তে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা করে সরকার। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এগুলোর মধ্যে সরকারী উদ্যোগে চারটি এবং সরকারী-বেসরকারী অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় বেসরকারী উদ্যোগে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সরকারী উদ্যোগে নির্মাণাধীন চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো ‘মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল’, ‘মিরেরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল’, কক্সবাজারে ‘সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক’ এবং মৌলভীবাজারে ‘শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল’। বাকিগুলো বেসরকারী উদ্যোগে পিপিপির আওতায় নির্মাণাধীন। এছাড়া দেশে আরও ৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১টি সরকারী, বাকি ৮টি বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও শিল্প স্থাপন বাড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এগুলো প্রতিষ্ঠা হলে এর মধ্যে শিল্পায়ন হবে, এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ৪০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে। এতে বাড়বে জীবনযাত্রার মান। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলোর উন্নয়ন হবে। যা বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সরকারের সাড়ে নয় বছরে রিজার্ভ তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। অর্থনীতির স্বস্তিদায়ক জায়গাগুলোর অন্যতম ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ছে। এপ্রিল ২০১৮ বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, তাতে ৯ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত, আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি এবং প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্স এই রিজার্ভ গড়তে সহায়তা করেছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। তাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৫২ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৬১০ ডলার। এতে আগের বছরের চেয়ে আয় বাড়ল ১৪২ ডলার। এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৮০ কোটি ডলার বা ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×