ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার অধিকার আছে দামেস্কের ॥ তেহরান

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১২ মে ২০১৮

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের শঙ্কা

ইসরাইল ও ইরান প্রত্যক্ষভাবে অত্যন্ত মারাত্মক সঙ্ঘাত-সম্মুখীন হলে পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসরাইল যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ইরানী সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর ব্যাপক পর্যায়ে প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে অনেকের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি হয় যে, এ বিরোধী দুটি দেশ চরম যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। খবর গার্ডিয়ান অনলাইনের। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যাচ্ছে বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৃহস্পতিবারের ঘোষণার পর এ বৈরিতা শুরু হয়। চুক্তি থেকে ট্রাম্পের প্রত্যাহার ঘোষণা তেহরানকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সিরিয়া ও ইয়েমেন এর মধ্যে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, ইসরাইল ও ইরান ক্রমবর্ধমানভাবে এক আসন্ন সঙ্ঘাতের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরস ও ইইউয়ের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মাগেরিনি সংযত হওয়ার জন্য দু’পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গুতেরেসের মুখপাত্র বলেছেন, মহাসচিব অঞ্চলে নতুন করে সঙ্ঘাত এড়ানোর জন্য সব বৈরী কার্যকলাপ ও যে কোন উস্কানিমূলক তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখানে ভয়াবহ সঙ্ঘাতের জন্য এর মধ্যেই বেসামরিক লোকদের ওপর চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুয়ের কাছে এক টেলিফোন কলে ইরানী রকেট হামলার নিন্দা জানিয়েছেন টেরেসা মে। কিন্তু তিনি সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। অধিকৃত গোলাম মালভূমিতে ইসরাইলী সৈন্যদের ওপর রকেট হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করেছে তেল আবিব। ইসরাইল বৃহস্পতিবার দাকি করেছে, তারা ইরানী রকেট হামলার জবাবে সিরিয়ায় ইরানের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইসরাইলী সৈন্যদের ওপর রকেট হামলার সংবাদ সত্য হলে এটাই হবে তাদের ওপর প্রথম প্রত্যক্ষ রকেট হামলা। লেবাননী গ্রুপ হেজবুল্লাহর মতো জঙ্গী সংগঠনগুলো এখানে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপুর যুদ্ধের পর সিরিয়ায় ইসরাইলের এ প্রতিশোধমূলক হামলা সবচেয়ে বৃহত্তম আঘাত। ইসরাইলী সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা তেহরানের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি গোলাবারুদের গুদামসহ ইরানী কুদগস লজিস্টিকস প্রধান দফতরগুলোতে আঘাত করেছে। সিরিয়ায় ইসরাইলের হামলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ইরান বলেছে, এ ধরনের আগ্রাসনে নিজেদের রক্ষার পূর্ণ অধিকার আছে দামেস্কর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই তেহরান তার অন্যতম মিত্র সিরিয়ার পাশে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছে। ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই দামেস্কের দক্ষিণে কিসবেহ এলাকায় ইসরাইল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় বলে দাবি করে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসএএনএ। সিরিয়ায় সাত বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারী বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করছে ইরানের কুদস ফোর্স ও লেবাননভিত্তিক গেরিলা দল হিজবুল্লাহ। টালমাটাল মধ্যপ্রাচ্যে আসাদ ও হিজবুল্লাহকে আগে থেকেই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করছে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুদ্ধে এদের ধারাবাহিক বিজয় কপালে ভাঁজও বাড়িয়েছে ওয়াশিংটন- তেল আবিবের। নিজের সীমান্তের উত্তর দিকে লেবাননি-সিরিয়ান ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ইসরাইল সিরিয়ায় ইরান ও হিজবুল্লাহর অবস্থানগুলোতে বার বার বিমান হামলা চালাচ্ছে। ৯ এপ্রিল সিরিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে এ ধরনের এক হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর সাত সদস্য নিহত হন। ওই হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। বৃহস্পতিবার ইসরাইলের দখলে থাকা গোলান মালভূমিতে পাল্টা রকেট হামলা চালায় ইরান। এরপরই এর প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ায় সাত বছরের মধ্যে বড় ধরনের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেল আবিব। ইরান ও ইসরাইলের এ পাল্টাপাল্টিকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হতে পারে বলেও সতর্ক করছেন পর্যবেক্ষকরা। এর মধ্যেই শুক্রবার ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাশেমীর বরাত দিয়ে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিরিয়ার পক্ষে নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে। ‘সিরিয়ায় (ইসরাইলের) হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে ইরান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা ইসরায়েলকে আগ্রাসন চালানোর ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। নিজেদের রক্ষা করার পূর্ণ অধিকার আছে ইসরাইলের,’ বাহরাম কাশেমী এমনটাই বলেছেন বলে জানিয়েছে ইরানি টেলিভিশন। ইসরাইলি মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কোনরিকাস জানান, বৃহস্পতিবার ইরানি বাহিনীর ছোড়া রকেটগুলোর মধ্যে ‘অল্প কয়েকটিকে’ ধ্বংস করেছে ইসরাইল, বাকিগুলো আঘাত করলেও ইসরাইলী অবস্থানের ‘সীমিত’ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ‘আমরাও পাল্টা হামলা চালিয়েছি, কিন্তু ওই বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানা নেই,’ বলেছেন তিনি। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, বহু ইসরাইলি রকেট রাডার স্টেশন, সিরিয়ার এয়ার ডিফেন্সের অবস্থানে এবং অস্ত্রগুদামে আঘাত হেনেছে। সীমান্তবর্তী এইতনিত্রার বাথ শহরেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। এরপর পর পর আরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসএএনএ। রাজধানী দামেস্ক, হমস ও সুইদায় ইসরাইলী ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ধ্বংস করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে বার্তা সংস্থাটি। সামরিক এক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এসএএনএর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এয়ার ডিফেন্স বহু ইসরাইলী রকেট ধ্বংস করেছে, তবে কয়েকটি লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে, এতে একটি রাডার কেন্দ্র ধ্বংস হয়েছে।’ আরেকটি রকেট একটি অস্ত্রগুদামে আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে তারা। ট্রাম্পের ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসার দুই দিনের মাথায় সামরিক শক্তি বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী এ দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ হলো। ইসরাইল ও ইরান আগে থেকেই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান ধারাবাহিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে দশককাল ধরে অভিযোগ তেল আবিবের। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।
×