ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন সন্ত্রাসবিরোধী গণকনভেনশন

যৌন সন্ত্রাস রোধে সুনির্দিষ্ট আইন দাবি

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১২ মে ২০১৮

যৌন সন্ত্রাস রোধে সুনির্দিষ্ট আইন দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যৌন সন্ত্রাস রোধে সুনির্দিষ্ট আইনের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, সম্প্রতি যৌন সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। এদেরকে রুখে দিতে জেগে ওঠার এখনই সময়। তবে এর জন্য চাই নির্দিষ্ট আইন, সচেতনতা সৃষ্টি এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি। পাশাপাশি এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সমাজ থেকে এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড উঠে যাবে বলেও মত দিয়েছেন তারা। শুক্রবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে যৌন সন্ত্রাসবিরোধী গণ-কনভেনশনে এসব কথা বলেছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে কনভেনশনের আহ্বায়ক ডাঃ লেনিন চৌধুরী ‘যৌনসন্ত্রাস : সঙ্কট ও উত্তরণ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি ৯টি সুপারিশ তুলে ধরেন। বক্তারা বলেন, ধর্ষণ, যৌন আক্রমণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌনতা বিষয়ে সংঘটিত অপরাধগুলোকে ‘যৌন সন্ত্রাস’ বলা হচ্ছে। এটি একটি নতুন শব্দ। এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সমাজ থেকে এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড উঠে যাবে। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘ধর্ষণসহ বেশিরভাগ অপরাধকে প্রশ্রয় দেয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। কারণ, বেশিরভাগ অপরাধী হয় ক্ষমতাসীন দলের কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা, নয়ত দলের এ্যাক্টিভ কোন কর্মী। তারা অপরাধ করতে ভয় পায় না। কারণ, তার দলের ক্ষমতার জোর। এ থেকে বের হয়ে আসতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। আর এই গণ-কনভেনশনই হতে পারে সে রকম একটি প্ল্যাটফর্ম।’ মানবাধিকার কর্মী অধ্যাপক নাসিম আখতার হুসাইন বলেন, ‘এক সময় নারীরা ঘরে-বাইরে যেভাবে মুখ বুঝে নির্যাতনের শিকার হতো, এখন আর তারা মুখ বুঝে সহ্য করে না। এখন তারা প্রতিবাদ করতে শিখেছে। নারীকে আর দুর্বল ভাবার সুযোগ নেই। আর দুর্বল ভাবতে পারে না বলে ওইসব নির্যাতনকারী পুরুষরা এখন পিছু হটছে। ঘরে স্ত্রীকে এবং নারীদেরকে সম্মান দিচ্ছে। কিন্তু যারা এখনও শোধরায়নি তাদের সংখ্যা একটু বেশি। আমরা চাই, এই গণ-কনভেনশনের মাধ্যমে এই বার্তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে, যাতে যৌন সন্ত্রাসীরা ভয় পায়। এদিকে যেন পা না বাড়ায়।’ মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, যৌন সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে প্রচুর সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন সেক্টরের মানুষদের মধ্যে সেটা করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভেতরে। দেশে অনেক প্রকল্প পুলিশ প্রশাসনকে নারীবান্ধব মানসিকতা তৈরিতে কাজ করেছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হয় না। পুলিশদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে গেলে উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি আনতে হয়। আর এই অনুমতি পাওয়াও এতটা সহজ না, এটা পুলিশ জানে। এ কারণে তারা এসব বেশি বেশি করে। ফলে সামগ্রিকভাবে যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’ গণ-কনভেনশনে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নারী, ছাত্র, যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। কনভেনশনে সুপারিশগুলো হলো ১. ‘যৌন সন্ত্রাসবিরোধী এবং নির্মূল আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হোক। এই আইনে ধর্ষণসহ সব যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ষোল বছরের কম বয়সী মেয়ে/ছেলেকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। ষোল বছরের উর্ধে অবস্থা ভেদে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ অন্যান্য শাস্তির বিধান থাকবে। অন্যান্য যৌন অপরাধকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মিথ্যা অভিযোগকারীকেও শাস্তি প্রদানের বিধান যুক্ত থাকবে। ২. যৌন সন্ত্রাস সংক্রান্ত মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি দেখা গেলে, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। ৩. স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সমতা এবং পারস্পরিক সম্মানবোধের বিষয়ে পাঠদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ৪.সামাজিক পরিমণ্ডলে স্থানীয় সরকার, তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ার লক্ষ্যে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে। ৫. যেহেতু যৌন অপরাধের মূল অংশের হোতা হচ্ছে পুরুষ, সেহেতু পুরুষদেরকে যৌন সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণার কাজে উদ্বুদ্ধমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ৬. এক সময় ‘ওরসেলাইন’-কে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য সরকারী-বেসরকারী গণমাধ্যমে যেরকম ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিল, সেরকম প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বার্তা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। এজন্য সকল ধরনের গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে। ৭. যৌন সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণায় ভুক্তভোগীকে নয়, অভিযুক্তকে সবার সামনে তুলে ধরার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এর অন্যথা হলে সেটাকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ৮. বিকৃতকামীদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ করা। ৯. ইন্টারনেটসহ সব ধরনের মাধ্যমে পর্নগ্রাফি ও যৌন উত্তেজক সামগ্রির সহজলভ্যতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণেরও দাবি জানানো হয় কনভেশন থেকে।
×