ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চির নবীনের কবি

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ১১ মে ২০১৮

চির নবীনের কবি

সুকান্ত ভট্টাচার্য অগ্নিময় এক কবিপুরুষ। তাঁর কবিতার ভুবন বিদ্রোহের আগুনে ঝলসানো। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। সুকান্ত ছিলেন উচ্চতর মানবিক বোধে আক্রান্ত কবি। তিনি তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। বালক বয়সে তিনি ভাবনান বৈতরণীতে অনেক বেশি অগ্রসর হয়েছিলেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা, অর্থাভাব তাকে কখনও দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। বেজে উঠলো কি সময়ের ঘড়ি এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি আমরা সবাই যে প্রহরী উঠুক ডাকÑ উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে জ¦লুক আগুন গরিবের হাতে ভীরুরা থাক কোটি কড়াঘাতে পৌঁছাক দ্বারে মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি। সুকান্ত তার কবিতার মাধ্যমে মেহনতী মানুষের কাছে যুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সুকান্তের কবিতা শক্তি জুগিয়েছে। সুকান্ত শ্রেণী বিভক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। মানুষের সমঅধিকার বাস্তবায়নের জন্য তিনি নিরলস কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ কবি। অসহায় মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা ছিল বিশাল। দোর্দ- প্রতাপে তিনি অসহায়দের স্বার্থে সংগ্রাম করেছেন। সুকান্তের কবিতা অধিকার অর্জনের আন্দোলনকে গতিময় করতে সহায়ক হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রকে তিনি কবিতার উচ্চারণ দিয়ে রুখতে চেয়েছেন। সুকান্ত তার কবিতার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৩৩৩ সালের ৩০ শ্রাবণ কলকাতার বাগবাজারের একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে সুকান্ত তার জ্যাঠতুতো বোন রানী’দির কাছে প্রথম কবিতার পাঠ শেখেন। সুকান্ত সাহিত্যের পরিবেশ পেয়ে যান পারিবারিক পরিম-ল থেকে। সুকান্তের জ্যাঠা এমন সাহিত্যপাগল মানুষ ছিল যে, তিনি হিসাবের খাতা লিখতেন পদ্যে ছন্দে। সুকান্তের প্রধান সহচরী ছিলেন তার প্রিয় রানী’দি। সুকান্তকে সাহিত্যে আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে রানী’দির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সুকান্তের যখন আট বছর বয়স তখন তার প্রিয় রানী’দির মৃত্যু হয়। রানী’দির অকাল প্রয়াণে সুকান্তর ভীষণ শোকার্ত হয়ে পড়েন। রানী’দির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সুকান্তদের যুক্ত পরিবার ভেঙে যায়। এ সময় সুকান্ত পরিবার ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করে। সুকান্ত নয়-দশ বছর বয়সে সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন। কবিতা লেখা শুরু করেন। তার শিশুমনের ভাবনা দিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেন। বল দেখি জমিদারের কোনটি ধাম জমিদারের দুই ছেলে রাম শ্যাম রাম বড়ো ভালো ছেলে পাঠশালা যায় শ্যাম শুধু ঘরে বসে দুধভাত খায়। সুকান্তের এ ধরনের কবিতা বিজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত শিশু পত্রিকা ‘শিখা’য় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হতে থাকে। সুকান্তের মমতাময়ী মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মায়ের মৃত্যু সুকান্তকে প্রচ- বেদনার্ত করে। দিশেহারা-অসহায় সুকান্ত এ সময় লেখেন। হে পৃথিবী আজকে বিদায় এ দুর্ভাগা চায় বিস্মৃত শৈশবে যে আঁধার ছিল চারদিকে তারে কি নিভৃতে আবার আপন করে পাবো। ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সুকান্ত ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সুকান্ত তার কবি চেতনার গুরু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় সুকান্ত ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের মুখপত্র ‘অকাল’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এ সময় সুকান্তের ‘বোধন’ কবিতাটি সে সময়ের লেখক ও পাঠকদের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। আদিম হিং¯্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই স্বজন হারানো শ্মশানে তোমাদের চিতা আমি তুলবোই। জগদীশ ভট্টাচার্য এ কবিতাকে এ যুগের মহাকাব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বোধন’ এ যুগের শ্রেষ্ঠ প্রেরণা, শ্রেষ্ঠ কাব্য। সুকান্ত ম্যালেরিয়া ও টাইফয়ের রোগে আক্রান্ত হন। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই আঠারো বছর বয়সের এই কবি কর্মক্ষেত্রে ছুটে যান। এ সময় তিনি নির্ভয়ে উচ্চারণ করেনÑ আঠারো বছর বয়সে নেই ভয় পদাঘাতে চাই ভাঙ্গতে পাথর বাধা এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয় আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্ত ছিলেন স্বল্পায়ু। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় যাদবপুর টিবি হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর ১৩৫৪ সালের ২ বৈশাখ ডাক্তারদের অবহেলার কারণে বিরল শক্তিধর এই কবি প্রতিভার মৃত্যু হয়। সুকান্তের অকাল প্রয়াণ সাহিত্যের অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে।
×