ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতাসমগ্র-১ আতাতুর্ক কামাল পাশা

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ১১ মে ২০১৮

কবিতাসমগ্র-১ আতাতুর্ক কামাল পাশা

পুকুরের জল নিস্তরঙ্গ মরণ নেশার ঘোরে যখন স্বপ্ন কুটিরে সানাইয়ের সুর থেমে গেছে যখন কোন প্রাণী আর প্রাণময় থাকে না কেবল মহাকাশে ধূলিকণার মতো উড়তে থাকে তখন নয় বরং যখন পদ্মফুল পাপড়ি মেলে যখন অনুভবের অভিধার পাতাগুলো ঝড়ের মধ্যে উড়তে থাকে যখন সময়ের অচেতনে শহরময় তুষারপাতে রিরংসার গোলাপী গালে প্রিয়াংকার ঠোঁটে অস্ফুটভবে প্রজ্ঞার যে বাণী প্রকাশ করে সে বাণী নিয়েই কাব্য শুরু মেহরাব রহমানের। অন্তত তাঁর কবিতা সংগ্রহ ১-এর প্রায় পৌনে দু’শো কবিতাকে ব্যবচ্ছেদ করলে এমনটি মনে হয়। মেহরাব রহমান কোন বিশেষ দশকের বলে নিজেকে পরিচয় দিতে অনীহাবোধ করলেও গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি লিখছেন, বিশেষ করে কবিতা। তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে থাকলেও নিরবচ্ছিন্ন কবিতা লিখে যাচ্ছেন প্রবাসে থেকেও। কয়েকটি বাংলা পত্রিকা সেখানেও বের করছেন, বাংলা সংস্কৃতির বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও সেখানে জড়িত। তারো আগে তিনি দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত লিখতেন, বিটিভি ও অন্য চ্যানেলগুলোতে কবিতা পড়তেন, তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার হয়েছিল। গৌরচন্দ্রিকায় যে প্রজ্ঞার কথা বলা হয়েছে সেটিই শেষতম অভিজ্ঞা মেহরাব রহমানের, ‘দীর্ঘমেয়াদী ঋণ/ শোধ দিতে দিতে/ একদিন চিতার আগুনে জ্বলা/ অথবা মাটির অতলে মিশে যাব জানি।/ আগামীর হাতে থেকে যাবে/ অজন্তার রক্তলেখা এই দিনলিপি।’ (অজন্তার দিনলিপি/ পৃ-২৭৫ ॥ ‘নষ্টবীজ’ কাব্যগ্রন্থ)। মেহরাব রহমানের লেখা বুঝতে হলে আমাদের চরম বাস্তবাদিতায় আসতে হবে, জীবনের শুদ্ধতায় আসতে হবে, এক হিসেবে মেহরাব রহমান জীবনানন্দের শুদ্ধতম কবি-এর স্থলে ‘শুদ্ধতম জীবনবাদি কবি’ হিসেবে আমাদের কাছে গৃহীত হতে পারে যদি আমরা তার কবিতাগুলো অণুবীক্ষণে পড়ি, ‘মধ্যগগন থেকে কখন যেন পরিণত মধ্যাহ্নের দিকে/ সূর্র্য হেলে পড়ে পশ্চিমে/ তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে/ এভাবেই দূর দিগন্তের দিকে দীপ্ত/ পায়ে হেঁটে যাওয়া’ (কোথায় খুঁজব তোমাকে/ পৃ-৪৯ ॥ ‘সূর্যোদয়ের পাঠশালা’ কাব্যগ্রন্থ।) বাস্তবতাকে বাস্তবের বাগানে রেখে তিনি বাস্তববাদি যা স্বভাবজাত্য শুদ্ধতম কবি হয়ে ওঠেন। মেহরাব রহমানের কবিতার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে চলমান দিনগুলো, মুহূর্তগুলো যখন বীক্ষণ করতে করতে একটি চরম বাস্তব জীবকল্পের চিত্র তাঁর মাথার কোষে কাব্যরাণী গুন গুন করে গেয়ে ওঠে তখনি তার কবিতা ভূমিষ্ট হয়। আর এ কারণে তিনি খুব সহজেই পৃথিবীর মানব জীবনের জন্ম, কর্মমুখরতা, শিল্পকাতরতা, প্রবীণতার চাদর গায়ে জড়িয়ে পথচলা শুরু করে, শেষে নিরুদ্দেশের পথে সহজভাবে চলে যান, ‘করমালির বিবর্তিত পৃথিবী/ আজ আর কোন রবীন্দ্র- জোছনায়/ যায় না মাতাল সমীরণে/ বনলক্ষীর বনে/ এ যেন বয়োজ্যেষ্ঠ অক্ষম পৃথিবী/ স্খলনহীন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে/ চাঁদ চন্দ্রিমার কাছে’ (এখানেই কালের বিষণœœতা/ পৃ-২৯-৩০ ॥ ‘সূূর্যোদয়ের পাঠশালায়’ কাব্যগ্রন্থের)। ‘এখানে অনেক ছিল বাঁচার খোরাক/ শীতের শিউলি ঝরে শীতের কুয়াশায়/ জানি না কেন আবেগশূন্য এ মন/ এই যে আমাদের এ পথ থেকে অন্য পথে যাওয়া/ হয়তো জন্ম থেকে অন্য জন্মান্তরে পাড়ি দেয়া’ (আমরা যাচ্ছি চলে/ পৃ-৫৫ ॥ কাব্যগ্রন্থ প্রাগুক্ত) মেহরাব রহমান মৃত্যুকে খুব স্বাভাবিক বলে মনে করে নিয়েছেন তার কাব্যে জীবনের বিশুদ্ধতায়। তবে যতক্ষণ এ পৃথিবী নামের গ্রহে আছেন ততক্ষণ তার জীবনে আছে সঙ্গীত, কাব্যময়তা, কর্তব্য, জীবনে আছে এভাবে ... ‘নমস্য সূর্যের কাছে কবির বিনম্র প্রার্থনা/ মধ্য গগনে তুমি জেগে ওঠো,/ তাপশক্তি সঞ্চারিত হোক দিকে দিকে;/ গলে যাক হীম শীতে জমে যাওয়া সব কিছু।/ কেবল হিমাঙ্কের নিচে যুগ-যুগান্তর থেকে যাক হিংসা, প্রতিশোধ/ ক্রোধ এবং যুদ্ধ।’ (হিমাঙ্কের নিচে/ পৃ-২০৪ ॥ ‘আমি ক্রীতদাস’ কাব্যগ্রন্থ)। সব কবিরই কবিতা লেখার নিজস্ব দিঙবলয় থাকে বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ কেউ হন তাহলে তো অবশ্যই। মেহরাব রহমানের কবিতার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথমতঃ কবি নিজেকে কখনো অতিলৌকিক কবি মনে করেন না, উত্তরাধুনিক বা অনাধুনিক, শহুরে বা গ্রামের কবি হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে চান না। প্রবাসে বসেও তিনি যখন কবিতা লেখেন সেখানেও পরিবেশের সামান্য বর্ণনা থাকে মাত্র আর কবিতা তার শুদ্ধতা নিয়ে আপন গতিতে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয়তঃ মেহরাব রহমান হঠাৎ করে চমক দেয়ার জন্য বা চমকপ্রদ কিছু লিখে রাতারাতি সবার নজর কেড়ে নেবার চেষ্টা করেন না। তিনি কবিতায় জীবন ও বাস্তবতা নিয়েই কাজ করেন। স্ট্যান্ট দেবার জন্য কোন বিশেষ শব্দ এমনকি বিশেষভাবে কোন কবিতার কাঠামো নির্মাণ করেন না। শুরুতেই যেমনটি বলা হয়েছে অনুভবে সিক্ত হতে হতে কাব্যরানী যখন কবিতার বরমাল্য তাকে দেন ঠিক তখনি তিনি কবিতা লিখতে বসেন। তৃতীয়তঃ কবিতায় তিনি কখনোই অমরত্ব সন্ধান করতে আগ্রহী নন। চারদিকের জীবন নিয়ে চলিঞ্চু মানুষের জীবনের কথা বলে যান নির্ভেজালভাবে। বাস্তবতার বাইরে কোন কিছু তিনি তার কবিতায় ধারণ করেন না। এ কারণেই তার কবিতাগুলো হয়ে ওঠে বিশুদ্ধ আর তিনি হয়ে ওঠেন শুদ্ধতম জীবনবাদী কবি। নিসন্দেহে এ কাব্যসমগ্রটি তাঁর ছয়টি কাব্যগ্রন্থের একক কবিতা সংগ্রহ যা পাঠকদের এ কালের একজন কবিতার ওপর সম্যাক ধারণা আনতে সাহায্য করবে। প্রচ্ছদ সুন্দর। মুদ্রণ ও অঙ্গবিন্যাস বেশ পরিপাটি।
×