ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিভু রঞ্জন সরকার

প্রথা বিরোধী সংকেত

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১১ মে ২০১৮

প্রথা বিরোধী সংকেত

সতর্ক, পরিপক্ব আর সংবেদনশীল পাঠকের প্রথমেই যা নজর কাড়বে, তা হলো পুষ্পিতা রায়ের কবিতার পঙক্তি বিন্যাসের বিশিষ্টতা। প্রায় প্রতিটি কবিতাই যেন এক মুঠো জীবন, একটি ছোট ক্যানভাসে। ছোটগল্পের আঙ্গিকে। কবিতার লাইন বা পঙক্তি তাই দীর্ঘ হয় কবিতার প্রয়োজনেই। কবিতা হারায় না। উল্টো তা নতুন বিস্ময় নিয়ে আসে। কবিতার সকল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখে প্রবহমান জীবনের মুহূর্তকে পুষ্পিতা রায় ধরেছেন তার নিজস্ব করণকৌশলে। সফল তিনি। সফল তার কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টিস্নাত পিয়ানো।’ ‘দিশেহারা ছোটে সে, আছড়িয়ে পড়ে সে, দাঁড়ালেই ঝড় মারে ধাক্কা। সারা গা ছড়ে যায়, হাড় ভাঙ্গা বেদনায়, মনে হয়, পেল বুঝি অক্কা। এমন সময়, মাহাবুব ভাবে, মরবো? মরতে হয় যদি মরবো।’ (ঝড়ের পরে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই রচনায় পঙক্তির প্রচলিত বিন্যাস উপেক্ষিত। একটি ছোট গল্প, যার শরীর নির্মিত কবিতার আঙ্গিকে। অন্ত্যমিল এবং ছন্দ সমেত। পুষ্পিতা রায়ের কবিতা পড়তে গেলে এ রকম অনুভূতি হতেই পারে। কবিতা অথচ প্রচলিত পঙক্তি বিন্যাসের ধারা তছনছ করে দিয়েছেন তিনি। না, তাতে কবিতার শরীরে এতটুকু আঁচড় পড়েনি, ক্ষতি হয়নি। স্বাস্থ্যবান কবিতাগুলো কখনও ছোটগল্পের আঙ্গিকে, কখনও নাটকের সংলাপের আদল নিয়ে তরতর করে এগোয়। কবির নিজেরই স্বীকারোক্তি : বইয়ের কিছু কিছু কবিতা অনেকটা ছোটগল্পের মতো কাহিনীনির্ভর। চিত্রকল্পের ঠাঁস-বুনোটে কবিতাগুলো পুনর্বার চোখে পড়ে। নজর কাড়ে। সমসাময়িক কবিতা যখন সার্থক চিত্রকল্পের অভাবে পুষ্টিহীন শরীর নিয়ে ধুকপুক করছে, বৃষ্টিস্নাত পিয়ানো তখন ভিন্ন কথা বলে। চিত্রকল্পের জাদু পাঠককে দোলায়। ডোবায়-ভাসায়। কখনও ছিনতাই করে তাকে স্বপ্ন-জগতে নিয়ে যায়। ওই স্বপ্নের জগৎ পাঠকের কাক্সিক্ষত মনে হতেই পারে। ১. ’এক দুপুরে প্রজাপতি, জলফড়িং, জোনাকি, সন্ধ্যাতারার সব গল্প ভুলে যাব। অনন্ত সবুজ শোষণ করে করে হব তোমার দুর্বাদলশ্যাম।’ (এক দুপুরে তোমার হব) ২. ‘মন খারাপের সেই বিকেলে পুরোনো কোন জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসবো দুজন আমরা দুজন কেউ কাউকে বলব না ‘ভালোবাসি’। তবুও ভালোবাসার ছোট্ট গল্পের সাক্ষী হব’ (সাক্ষী হব) ৩. ‘ ... নীল খামে বন্দী করা একমুঠো শ্রাবণসন্ধ্যা পাঠিয়েছি তোমার জন্য। বেচারি পাখিটা সেই কখন থেকে ক্লান্ত ঠোঁটে খাম নিয়ে বসে আছে।’ (বৃষ্টি আলাপ) ৪. মায়ের হাঁটুস্পর্শী ঘনকালো চুলের দোল দেখলে আমার গাছ ভরা বেলি ফুল হতে ইচ্ছে করে। (আবার আমি মায়ের মেয়ে হব) ওয়েস্টল্যান্ড খ্যাত টি. এস. এলিয়ট যেমন বলেন, ‘এবহঁরহব ঢ়ড়বঃৎু পধহ পড়সসঁহরপধঃব নবভড়ৎব রঃ রং ঁহফবৎংঃড়ড়ফ.’ প্রচলিত ধারার একটু দূরে আছে বলেই পুষ্পিতা রায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টিস্নাত পিয়ানো’ পাঠের আগে কথাটি মনে রাখলে ভাল হয়। কবিতার জলে সাঁতার কাটা তখন সহজ হয়ে যায়। শিল্পের অনাস্বাদিত আনন্দ তখনই একটু বেশিই পাওয়া যায়। পাঠকের জন্যই এই কাব্যগ্রন্থ। লেখক নিজেকে রেখেছেন তার নিজেরই রচিত ঘেরাটোপে। কবিতার অন্তরালে। পেশায় নবীন চিকিৎসক এবং তরুণ কবি পুষ্পিতার কবিতার বইটি পাঠক পড়ে দেখতে পারেন, কবিতাপ্রেমীদের খারাপ লাগবে না। আমি তো এক বসায় পড়ে শেষ করলাম। পুষ্পিতা মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি কবিতার ভুবনে বিচরণ অব্যাহত রাখবে এবং কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করবে- এই প্রত্যাশা রাখছি। ওর জন্য শুভ কামনা।
×