ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ এবং আমাদের যাত্রা

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১১ মে ২০১৮

রবীন্দ্রনাথ এবং আমাদের যাত্রা

বাঙালীর ইহকাল ও পারলৌকিক সব ক্রিয়াকর্মের আলোকরশ্মি এবং বাঙালী জাতিসত্তার চিরসবুজ, চিরনবীন উজ্জ্বল পুরুষ বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহাকালের মতো অসীম আর অতলান্ত জলরাশির মতো রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে তাঁর নিজস্ব নাট্য রচনার ধারাটিও। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ কেবল নাটক ব্যতীত বাংলা সাহিত্যের যদি অন্য কোন বিভাগে হস্তক্ষেপ নাও করিতেন, তাহা হইলেও তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করিতে পারিতেন।’ পাশাপাশি আবার এই সত্যটিও গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃত হয়েছে যে, তাঁর কোনো কোনো নাটক, যেমন কাব্যনাটক ও গীতি নাট্যগুলোয় যাত্রার বৈশিষ্ট্যের ছায়াপাত ঘটেছে। ড. উপেন্দ্রনাথ ঘোষ মনে করেন, যাত্রার আঙ্গিক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁর মূল্য তিনি স্বীকার করেছেন। ভারতের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আনন্দলাল। ২০০১ সালে ভারত বিচিত্রায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঋতুভিত্তিক নাটকগুলো (শারদোৎসব, শেষ বর্ষণ, ফাল্গুনি, বসন্ত) লিখেছিলেন যাত্রার বাহ্যিক পরিবেশ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে।’ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে উপলব্ধি করা সহজ হবে, যাত্রার আঙ্গিকে যতটা না তিনি প্রভাবান্বিত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি এই শিল্পের কিছু কিছু বিষয়কে পরিশীলিত করেছেন। সাহিত্যের মানদ-ে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। যাত্রার বিবেকের রূপান্তর ঘটিয়েছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনতত্ত্বের মধ্য দিয়ে। কয়েকটি উদাহরণ- ‘চিরকুমার সভা’র (১৯০৭) অক্ষয়, ‘শারদোৎসবে’র (১৯০৮), ঠাকুর দাদা, ‘রাজা’র (১৯১০), বাউল ও পাগল, ‘অচলায়তনে’র (১৯১২) পঞ্চক, ‘ডাকঘরে’র (১৯১২) দাদা ঠাকুর, ‘ফাগ্নুনি’র (১৯১৬) অন্ধ বাউল, ‘মুক্ত-ধারা’র (১৯২৩) ধনঞ্জয় বৈরাগী ও ‘রক্তকরবী’র (১৯২৬) বিশু পাগল। উপরোক্ত নাটকগুলোর ভাববিন্যাসেই আমরা বুঝতে পারি, যাত্রার অন্তরধর্মকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন, বিকৃতিকে নয়। এই পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা কবিগুরুকে আধুনিক যাত্রার সংস্কারক হিসেবে অভিহিত করতে পারি। আবার যাত্রা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ের বয়ান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এই ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর হৃদয়ের ব্যাকুলতা কতইনা গভীর ছিল! ১৯০২ সালে প্রকাশিত ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামে এক প্রবন্ধে যাত্রাপালা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধি ছিল এরকমÑ ‘ভারতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ বোধ করি না।... আমাদের দেশের যাত্রা আমার ঐ জন্যই ভালো লাগে। যাত্রার অভিনয়ে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে একটা গুরুতর ব্যবধান নাই। পরস্পর বিশ^াস ও আনুকূল্যের ওপর নির্ভর করিয়া কাজটা বেশ সহৃদয়তার সহিত সুসম্পন্ন হইয়া থাকে। কাব্যরস, যেটা আসল জিনিস, তা আলোর ফোয়ারার মতো পুলকিত দর্শকচিত্তের ওপর ছড়াইয়া পড়ে।’ এ প্রসঙ্গে ‘জীবন-স্মৃতি’তে তিনি আরও লিখেছেন- ‘আমাদের দেশের চিরপ্রচলিত যাত্রার পালাগানে লোকের ভিড়ে স্থান সংকীর্ণ হয় বটে, কিন্তু পটের ঔদ্ধত্যে মন সংকীর্ণ হয় না। এ কারণে যে নাট্যাভিনয়ে আমার কোনো হাত থাকে, সেখানে মনে মনে দৃশ্যটি উঠানো-নামানোর ছেলেমানুষী আমি প্রশ্রয় দিই নে। কারণ বাস্তব সত্যকে এ বিদ্রƒপ করে, ভাব সত্যকেও বাধা দেয়।’ রবীন্দ্র-গবেষকদের লেখা থেকে জানা যায়, শৈশব থেকে তাঁর মধ্যে যাত্রাগানের অনুকূলে একটা সংস্কার গড়ে উঠেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে প্রায়ই যাত্রার আসর বসতো। রবীন্দ্র-অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) ‘সরোজিনী’ নামে একটি যাত্রাপালা লিখেছিলেন, তাতে অভিনয় করেন পেশাদার শিল্পীরা। ঠাকুরবাড়িতে ছোটদের যাত্রা দেখার অনুমতি ছিল না। সেই কঠোর অনুশাসন ডিঙিয়ে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ একটি পালা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। মহাভারতের এক আখ্যান অবলম্বনে রচিত তার নাম ‘নল-দময়ন্তী’। ‘ছেলেবেলা’ বইটিতে কবিগুরু সেই স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে: ‘...সব তাতে মানা করাই বড়দের ধর্ম। কিন্তু একবার কী কারণে তাদের মন নরম হয়েছিল। হুকুম বেরোল, ছেলেরাও যাত্রা শুনতে পাবে। ছিল ‘নলদময়ন্তী’ পালা।... এক সময় ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হয় বাইরে। চোখে ধাঁ ধাঁ লেগে গেল। এক তলায় দোতলায় রঙিন ঝাড়-লণ্ঠন থেকে ঝিলিমিলি আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। সাদা বিছানা চাদরে উঠোনটা চোখে ঠেকছে মস্ত...। রাত ফুরোত, কিন্তু যাত্রা ফুরোতে চাইত না।’ বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনা যাত্রামঞ্চে পরিবেশনের একটি শুভ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। যেমন কবিতা ও গল্পের যাত্রা রূপায়ণ, বিভিন্ন যাত্রাপালায় কিছু কিছু দৃশ্যে কবিতার উদ্ধৃতি, পালা মঞ্চায়নের শুরুতে গীত ও নৃত্য পরিবেশনা। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস, ছোটগল্প এবং কবিতা নিয়ে রূপান্তরিত যাত্রাপালার সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ছয়টি রচনা যাত্রাপালাকারে পরিবেশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে : নাটক- বিসর্জন, উপন্যাস-বৌ ঠাকুরাণীর হাট, ছোটগল্প- কাবুলিওয়ালা, কবিতা- মস্তক বিক্রয়, পূজারিণী ও সামান্য ক্ষতি। বৌ ঠাকুরাণীর হাট উপন্যাস থেকে পালা তৈরি করেন নাট্যকার মন্মথ রায়। অভিনেতা সুজিত পাঠক কাবুলিওয়ালা গল্পের পালারূপ দেন। ‘মস্তক বিক্রয়’ কবিতা অবলম্বনে যাত্রাপালা ‘প্রতিশোধ’, পূজারিণী কবিতা নিয়ে যাত্রাপালা ‘শেষ আরতি’ এবং সামান্য ক্ষতি কবিতা থেকে যাত্রাপালা ‘সতী করুণাময়ী’ রচনা করেন ব্রজেন্দ্র কুমার দে। এর মধ্যে বেশিরভাগ পালা অভিনীত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন দলে। ১৯৬০ সালের পর আমাদের এই বাংলাদেশে কবিগুরুর দুটি যাত্রাপালা মঞ্চায়নের সংবাদ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরার প্রতিশোধ, আরেকটি জয়দুর্গা অপেরার পূজারিণী। বাসন্তী অপেরার ‘প্রতিশোধ’ পালায় সেকালের দুই স্বনামধন্য অভিনেতা অমলেন্দু বিশ^াস ও তুষার দাশগুপ্ত অভিনয় করেন। সেকালে যাত্রার নৃত্যগীত ছিল শৈল্পিক ও রুচিসম্মত। নারায়ণ নৃত্য, উড়িয়া নৃত্য ও সাপুড়ে নৃত্যের পাশাপাশি দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের সঙ্গীত সহযোগে যাত্রামঞ্চে একটি আলাদা ঘরানা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যাত্রাদলের মেয়েরা ‘এলো রে ফাগুন হাওয়া’, ‘আজি বসন্ত এসেছে দ্বারে’- ‘আমার পরাণ চাহা যায়’, ‘সকল দুঃখের প্রদীপ জে¦লে’- এসব গান যাত্রামঞ্চে পরিবেশন করতেন। যেভাবে কবিতার উদ্ধৃতি এসেছে- ‘একটি পয়সা’ যাত্রাপালায় শ্রমিক নেতা অশোক বলছে- ‘যুগ যুগান্তর কাল হতে/মানুষের নিত্য প্রয়োজনে/জীবনে মরণে/ওরা চিলকাল টানে দাঁড়/ধরে থাকে হাল/ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে/পাকা ধান কাটে।’ ‘জানোয়ার’ পালায় প্রকৃতিপ্রেমিক নায়ক অরণ্য সেনের সংলাপ- ‘ফিরে দাও সেই অরণ্য, লহ এ নগর।’ ‘এ পৃথিবী টাকার গোলাম’ পালায় জীবনের টানাপড়েন অস্থির এক যুবকের উচ্চারণ- ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।’ ১৯৮৪-৮৫ সালে মানিকগঞ্জের চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মঞ্চে আসে সামান্য ক্ষতি কবিতার গীতিনাট্য রূপায়ণ। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে দুই বাংলায় কবিকে বরণ করার যে মহোৎসব চলেছে, তার ভাগীদার হয়েছে যাত্রাশিল্পও। লোকনাট্য গোষ্ঠীর পরিবেশনায় বাংলা একাডেমির বইমেলা (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১) মঞ্চে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে (৭ মে ২০১১) পরিবেশিত হয়েছে সতী করুণাময়ী পালাটি। এবার দেশ অপেরার পরিবেশনায় বিভিন্ন জেলায় ‘সতী করুণাময়ী’ পালাটি মঞ্চায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা এখন তারুণ্য ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তে। দিনবদলের পালায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, জাতি ও তাবৎ সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্পেরও উত্তরণ ঘটাতে হবে নতুন চিন্তা চেতনায়, সমকালীন জীবন-ঘনিষ্ঠতায়। অবশ্যই এখানে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক। যাত্রা বিষয়ে তার আশৈশব ভালোবাসা ও অনুরাগ আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসেরই অংশ। ‘আমাদের দেশের যাত্রা আমার ভালো লাগে’ কিংবা ‘রাত ফুরোত, কিন্তু যাত্রা ফুরোতে চাইতো না-’ শতবর্ষেরও অধিককাল আগে এরকম অনেক চিরন্তন উক্তি আমাদের শুনিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ।
×