ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদে নারী

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ১১ মে ২০১৮

জঙ্গীবাদে নারী

অপরাধবিজ্ঞানের তত্ত্বে নারী-পুরুষের বিভেদ না থাকলেও ক্রিমিনোলজিক্যাল গবেষণায় সাধারণত নারীদের উহ্য রাখার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে নারীদের অপরাধের সঙ্গে সংযুক্ততার কারণে অপরাধগত কার্যক্রমের ওপর স্টাডি করা হয়ে থাকে। কারণ ইদানীং নারীরাও ভয়াবহ সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া জন্মগতভাবে কেউ অপরাধী হয়ে না জন্মালেও পরবর্তীতে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও অন্যান্য জৈবিক কারণে নারীরাও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী হুমায়ারা ওরফে নাবিলার জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া সংক্রান্ত নিউজ গুরুত্ব সহকারে দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়। তা ছাড়া দেশব্যাপী সিটিটিসির জঙ্গীবাদবিরোধী অভিযানেও দেখা যায়, পুরুষের পাশাপাশি নারীরা জঙ্গীবাদে আসক্ত। নারীদের জঙ্গীবাদে সংযুক্ততা নিয়ে সরকারসহ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সচেতন মহলে বিশেষ আলোচনা হচ্ছে। কেননা, নারীদের সংযুক্ততার ফলে জঙ্গীবাদের শেকড় স্থাপন ও বিস্তার খুবই সহায়ক হবে। তাই সকলেই জঙ্গীবাদে নারী শীর্ষক আলোচনায় উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক অপরাধ, সহিংস অপরাধ ইত্যাদি প্রপঞ্চের সঙ্গে সৃষ্টিকুলের শুরু থেকে পুরুষেরা প্রকটভাবে জড়িয়ে থাকলেও নারীদের প্রচ্ছন্ন অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে, বিশ্বায়নের যুগে, আধুনিক প্রযুক্তির বিকর্ষতায় পুরুষের ন্যায় নারীরাও জঙ্গীবাদের সঙ্গে প্রকটভাবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশেষত ২০০১-০৫ সালের শাসনামলে দেশব্যাপী জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিস্তৃতি সমগ্র দেশের মানুষকে ভয়াবহতার মুখোমুখি করেছিল এবং এখনও তার ভয়াবহতা চলছেই। শুরুর রেশ ধরেই এখনও বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটন সম্ভব হয়নি। সাউথ এশিয়ান টেররিজম পোর্টালের সর্বশেষ রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায়, ২০১৭ সালে জঙ্গীবাদী আক্রমণের হতাহত হয় ৮০ জন মানুষ মারা যায় যার মধ্যে ৩৪ জন নিহত হয় এবং ৪৫ জন আহত হয়। জঙ্গীবাদের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে এখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হতাহত মানুষ দিনাতিপাত করছেন, বহন করে চলেছেন সীমাহীন অত্যাচারের চিহ্ন। সে সময়ে আমরা দেখেছি, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে জামা’আতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ, জেএমবি, নিষিদ্ধ জঙ্গীগোষ্ঠীসহ আরও কিছু কমিউনিস্ট পার্টি জেলা শাখা এবং থানা শাখায় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নীরবে নিভৃতে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পুরুষের আড়ালে নারীদের খবরাখবর সংবাদ মাধ্যমে তেমন আসত না, যে ইস্যুটি নারী জঙ্গীবাদের বিস্তারে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক দেশে জঙ্গী আক্রমণ এবং জঙ্গী অর্থায়নের যোগানদাতা হিসেবে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর স্বাধীনতাকে চরম হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হতে পারে নারীরা কেন জঙ্গীবাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে? উত্তরের জন্য বিভিন্ন আঙ্গিক এবং দৃষ্টিকোণের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রথমত সাধারণত জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত পুরুষের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নারীরাও জঙ্গীবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। দ্বিতীয়ত ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অনুশাসনকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়ে অস্থিমজ্জায় ভুল চিন্তা বপিত হয়ে থাকে নারীদের। তৃতীয়ত অলৌকিকভাবে চলমান পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলার উন্মাদনা চতুর্থত হতাশা, বেকারত্ব, পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গীবাদের সঙ্গে। পঞ্চমত আর্থিক প্ররোচনা, সঙ্গীদের সান্নিধ্য এবং পরিবেশিক ছলনায় অনেক মেয়েরাই ধ্বংসাতœক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন প্রায়শই। শেষত গ্লোবালাইজেশন, মানি লন্ডারিং, জঙ্গীবাদের প্ররোচনায় বিভিন্ন ধরনের এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক সাহায্য এবং প্রশিক্ষণের সুযোগের কারণে নারীরা জঙ্গীবাদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ছেন। জঙ্গীবাদের সমস্যাটি দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্ব পরিম-লে বিকশিত হয়েছে। এর ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা বর্তমানে শিশু এবং নারীদের জীবনের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনীতি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, অপরাধ ত্বরান্বিত হওয়া, শিক্ষার মানের অবনমন ইত্যাদি সেক্টরে প্রভাব ফেলে থাকে জঙ্গীবাদ নামক ভয়াবহ ইস্যুটি। তাই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করার পূর্বেই সমূলে নিপাত করা উচিত। আর এ সমস্যার সমাধানের জন্য বহুমুখী প্রক্রিয়ায় নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় সমস্যাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জঙ্গীবাদের অর্থায়ন বন্ধে সর্বদিক দিয়ে প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, অর্থায়ন বন্ধ করতে পারলেই জঙ্গীবাদী কার্যক্রম অনেকাংশে বন্ধ হয়ে আসবে। প্রশ্ন আসতে পারে, নারী জঙ্গীবাদের অর্থায়ন আসে কোথা থেকে? স্বাভাবিকভাবে দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েরা জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা নিজেরাই জঙ্গী কার্যক্রমে অর্থায়ন করে থাকে। এ ছাড়াও একটি বিশেষ দলের পরিচালনায় পরিচালিত দেশে প্রায় ৫২১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন : স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল ও নানামুখী সংগঠন জঙ্গীবাদের অর্থায়নে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এ ছাড়াও বহির্বিশ্বে পরিচালিত ইসলামিক সংস্থা ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে আর্থিক সাহায্য পায় জঙ্গীভিত্তিক দলগুলো। বৈশ্বিক পরিম-লে প্রতিষ্ঠিত জঙ্গী গ্রুপগুলো হতেও আর্থিক প্রণোদনা পেয়ে থাকে জঙ্গী সংগঠনগুলো। পাশাপাশি নিজেদের চাঁদা, যাকাত ফান্ড ও অন্যান্য উৎস হতে আর্থিক সাহায্য পায় জঙ্গী সংগঠনগুলো। পুরুষ জঙ্গীদের তুলনায় নারী জঙ্গীরাও অপরাধের বিস্তার এবং ভয়াবহতার জন্য পূর্ণাঙ্গ নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে। অনেকাংশে নারী জঙ্গীরা দেশের নিরাপত্তার জন্য পুরুষের তুলনায় বেশি হিং¯্র এবং ভয়ানক। কারণ সন্তান জন্মদান, লালন-পালন এবং শিক্ষাদানের সঙ্গে মায়েরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন। তাই ছেলেমেয়েদের নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিচালিত করার সক্ষমতা বাবার তুলনায় মায়ের বেশি থাকে। পাশাপাশি বাচ্চাদের স্কুলিং সম্বন্ধে বাবাদের তুলনায় মায়েরা বেশি শক্তিশালী পর্যায়ে সচেতন থাকে। বাংলাদেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদভিত্তিক বই পুস্তক পাওয়া যাচ্ছে এবং ওইসব স্কুলে বাচ্চারা লেখাপড়া করলে তাদের জঙ্গীবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর সেই মা যদি জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সন্তানদের বেশি পরিমাণে জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা থাকে প্রায়শই। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, নারী জঙ্গীরা কার্যকারিতা সাপেক্ষে পুরুষের তুলনায় মারাত্মক বিপজ্জনক। এসব জঙ্গী নারী পাচার, মানি লন্ডারিং, মাদক পাচার এবং পুরুষদের বিভিন্ন প্ররোচনায় অসামাজিক কাজে সম্পৃক্ত রেখে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকেন। সুতরাং বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিয়ে সমূলে উৎপাটনের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবস্থা নিতে হবে ভবিষ্যতের স্বার্থেই। কারণ নারী জঙ্গীদের প্রভাব খুবই সুতীব্র। জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রমগুলোকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রপ্ত করার সক্ষমতা নারী জঙ্গীদের বেশি। কাজেই, জঙ্গীবাদের রাস্তায় নারীদের সূচনার যাত্রাকে যে কোন মূল্যে থামিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিশেষ বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাঙালীর হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুশাসনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের রোধ করা সম্ভবপর হবে। পাশাপাশি দক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করা ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নীতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। কাগজে কলমে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। সুতরাং নারী জঙ্গীবাদের ভয়াবহতা রোধে সর্বসম্মতিক্রমে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত, তাহলেই স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হবে।
×