ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাদের স্মরণে;###;নাজনীন বেগম

মায়ের মমতায় ॥ সন্তানের জীবন গড়া

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১১ মে ২০১৮

মায়ের মমতায় ॥ সন্তানের জীবন গড়া

মানব সভ্যতার আদি ও অকৃত্রিম শব্দ মা। মায়ের স্নেহ ছায়ায় সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই মাই তার সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানকে পরম যতেœ শুধু লালন-পালনই করেন না জীবন গড়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতেও রাখে অনবদ্য ভূমিকা। মায়ের সান্নিধ্য আর সাহচর্য কোন সন্তানের সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত সম্পদ। মাতৃত্বের অপার অনুভব নিয়ে কোন কন্যা শৈশব থেকে নিজের সমস্ত স্বপ্ন আর কল্পনাকে হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে লালন করতে থাকে। তাই মা কোন বিশেষ দিনের নয় কিংবা মাতৃত্ব হঠাৎ জেগে ওঠা কোন স্নেহবিলাসী রূপের ক্ষণিক আবেদনও নয়। সেই ছোট্ট বেলা থেকে পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে বালিকারা প্রিয়ার আবরণে সাজে, মাতৃত্বের আস্বাদে পুলকিত হয়। আশৈশব এই ইচ্ছা, সুপ্ত বাসনা কোন এক সময় পরিস্ফুট হয়, পরিপক্ব বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায়। ছেলেবেলার স্বপ্ন সফল হওয়ার পাশাপাশি দেবতার পূজা ও পূর্ণ পরিণতিতে রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ ছিলি আমার পুতুল খেলায় প্রভাতের শিব পূজার বেলায়, তোকে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি। তুই আমার ঠাকুরের সনে ছিলি পূজার সিংহাসনে, তারি পূজায় তোমার পূজা করছি। আর এটাই মাতৃত্বের শাশ্বত রূপ, অনির্বাণ দীপ্তি। মায়ার মমতায় নারীর যে চিরস্থায়ী শুদ্ধতা মাতৃমহিমা তারই শুভ মঙ্গল দীপ। এই কল্যাণময় প্রদীপ শিখায় সন্তানের জীবন আলোয় আলোয় ভরে ওঠে। একজন মা তার প্রতিদিনের সংসার ধর্মে সন্তানের প্রতি যে দায়বোধে নিজেকে যেভাবে সমর্পণ করেন সেখানে অন্যান্য কর্তব্য নিয়মবিধি একেবারে তুচ্ছ হয়ে যায়। মাতৃত্বের নিরবচ্ছিন্ন শুভ যোগে সংসার যেমন পূতপবিত্র হয়, আরাধ্য সন্তানদের জীবনও হয় নিষ্কণ্টক, নির্বিঘœই শুধু নয় নিরাপত্তা বেষ্টনীতেও আবদ্ধ। দশ মাস দশ দিন জঠরে ধারণ মা যখন সন্তানকে জগতের আলো দেখান সেই দুর্লভ সময়ের মতো মহিমান্বিত মুহূর্ত পৃথিবীতে অন্য কিছু হতেই পারে না। সন্তানের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করাকে মা কখনও কর্তব্যের আবর্তে ফেলতে চান না। বরং তার চেয়েও বেশি ভাবেন ভেতরের গভীর বোধ আর নাড়ির অকৃত্রিম টান। মায়ের কোলে সুরক্ষিত, নিশ্চিত যে কোন সন্তানের বড় প্রাপ্তিই নয় সম্পদও বটে। এই মহামূল্যবান সম্পদ থেকে যারা বঞ্চিত হয় তাদের মতো হতভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় দুনিয়ায় সবচেয়ে সুন্দর ছবি অবশ্যই মায়ের কোলে সন্তান। প্রাণপ্রিয় সন্তানকে সার্বক্ষণিক পরিচর্যায় ঘিরে রাখা প্রতিটি মায়ের নিজেকে নিবেদন করার এক অনবদ্য প্রয়াস। যার সঙ্গে অন্য কিছুকে কখনও মেলানো যায় না। স্নেহের দানে মাতৃত্বের গৌরবে মায়ের নির্দিষ্ট কোন জায়গাই তৈরি হয় না। সন্তানের কাছে মায়ের আসনের ব্যাপ্তি আর গভীরতা কোন কিছু দিয়ে পরিমাপও হয় না। সর্বসংহা মাতৃহৃদয় সন্তানের জীবনের সমস্ত বিপরীত স্রোতকে ধারণই করে না তা নির্মূলের জন্য যা কিছু করণীয় সবই করতে দৃঢ় প্রত্যয়ীও হয়। মায়ের নিবিড় স্নেহঘেরা আঁচলে সন্তানের যে পথচলা সেখানে অশুভ শক্তির কোন ছায়াই পড়তে পারে না। মাধুরী শাখা মায়ের স্নেহাতিশয্য সন্তানের জীবনপাত্র এক অপরিমেয় ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয়। একজন অবোধ শিশুর অস্পষ্ট, আধোবুলি বোঝার ক্ষমতা কেবল মায়েরই। সন্তান সর্বপ্রথম মায়ের কাছ থেকেই ন্যায়-অন্যায় বোধ কিংবা ভাল-মন্দের ফারাক চিহ্নিত করতে পারে। সুতরাং মাকেও অনেক বেশি সচেতন আর সজাগ থাকতে হয় সন্তানের মানবিক আর নৈতিক গুণাবলী তৈরি করার ক্ষেত্রে। যথার্থ মানুষ হয়ে সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে মায়ের বিকল্প আর কিছু থাকে না। জীবন গড়ার বিচিত্র আঙ্গিনা কখনও সহজলভ্য হয় না। কঠিন বাস্তবের অভিঘাতে সামনে চলার পথও কখনও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেক সাবধানে, সতর্কভাবে জীবনকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পথে নিয়তই চালিত করতে হয়। মোহগ্রস্ত কিংবা অশুভ শক্তির অপচ্ছায়ায় পতিত হওয়ার হাতছানি পদে পদেই। এখানেও জন্মদাত্রী, সর্বংসহা মাই হন সমস্ত মুশকিল আসান। মা শুধু স্নেহ দিয়েই সন্তানের জীবন পরিপূর্ণ করেন না, শাসনে, ঠিক-বেঠিক বোঝানোর তাগিদে মাই হয়ে ওঠেন সুস্থ, পরিচ্ছন্ন জীবন গড়ার কারিগর। মায়ায় ভরা পারিবারিক আবহ শুধু সন্তানের জীবনকেই পরিশুদ্ধ করে না বরং সার্বিক সামাজিক অবয়বকেও করে নির্মল আর স্নিগ্ধ। কারণ মা-বাবার আদুরে সন্তানরা যদি সুষ্ঠু এবং স্বাভাবিক উপায়ে নিজেদের জীবনকে সুন্দর আর যোগ্য করে তুলতে পারে তাহলে সামাজিক অবক্ষয় কিংবা কোন অপশক্তিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে ব্যর্থ হবে। পরিবার সমাজের ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান হলেও এর ভূমিকা কিংবা ব্যাপ্তি এত সম্প্রসারিত যে পুরো সামাজিক চেহারার ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়। সুতরাং সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধন নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে সুসংহত সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে। সুতরাং মা-সন্তানের সম্পর্ক শুধুমাত্র পারিবারিকই নয় একেবারে সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
×