ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নযাত্রার প্রযুক্তি ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১’

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১১ মে ২০১৮

স্বপ্নযাত্রার প্রযুক্তি ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রস্তাব দেন বাংলাদেশ যেন ভারতের আর্থ স্টেশন বা উপগ্রহ ভূকেন্দ্র ব্যবহার করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখে। তবে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে নিজ দেশেই আর্থ স্টেশন তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে রাঙ্গামাটিতে উদ্বোধন করেন দেশের প্রথম আর্থ স্টেশন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। সেই সময় থেকেই দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট বা উপগ্রহের চিন্তাভাবনা চলতে থাকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এই নতুন প্রকল্প চালু করেন। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট সদস্য দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে কাজ করছে এমন মানবসৃষ্ট কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের সংখ্যা প্রায় ১৪১৯। যার মাঝে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটের সংখ্যাই ৫৬০। কক্ষপথ স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়। মহাকাশে এই কক্ষপথের অবস্থান ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এই কক্ষপথ কেনা হয়। উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান ও রকেট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ করে এ বছরের ৩০ মার্চ একটি বিশেষ উড়োজাহাজে উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দেয় থ্যালাম অ্যালেনিয়া স্পেস। মার্কিন রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালে কেনেডি স্পেস সেন্টারে স্পেসএক্সের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে উড়বে ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেট। উৎক্ষেপণের সবচেয়ে বড় ধাপ স্যাটেলাইটটি বহনকারী ফ্যালকন নাইন রকেটের ‘স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্ট’ সম্পন্ন করেছে স্পেসএক্স। ৫ মে নিজস্ব টুইটার পেজে এ তথ্য জানায় প্রতিষ্ঠানটি। স্যাটেলাইটের গঠন স্যাটেলাইট অত্যন্ত দামী এবং জটিল একটি যন্ত্র। তবে স্যাটেলাইটের মূল কাজ খুব একটা জটিল নয়। স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্য প্রয়োজন শক্তি, যা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে স্যাটেলাইট সংগ্রহ করতে থাকে। পৃথিবী থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করা এবং পৃথিবীতে সিগন্যাল পাঠানোর জন্য প্রয়োজন সেন্ডার ও রিসিভার। মোটর এবং ইঞ্জিন ব্যবহার করে স্যাটেলাইট তার নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অবস্থান মহাশূন্য বলতে সাধারণত যা বুঝি তা পৃথিবী থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে শুরু হয়। পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্বের ওপর নির্ভর করে স্যাটেলাইটকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়- লো আর্থ ওরবিট (৩০০-২০০০ কি.মি উচ্চতায়), মিডিয়াম আর্থ ওরবিট (২০,০০০ কি.মি উপরে), জিওস্টেশনারি ওরবিট (প্রায় ৩৫,৭৮৬ কি.মি উচ্চতা) এবং হাই আর্থ ওরবিট (সর্বোচ্চ ৩৩০,০০০ কি.মি উচ্চতা)। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট হতে যাচ্ছে জিওস্টেশনারি ওরবিট স্যাটেলাইট। এই উচ্চতার উপগ্রহগুলো পৃথিবীর সঙ্গে একই গতিতে চলমান। তাই পৃথিবী থেকে দেখে এই সকল স্যাটেলাইটকে স্থির বলে মনে হয়। আর্থিক সুবিধা বর্তমানে স্যাটেলাইট অপারেটর থেকে ব্যান্ডউইথ ভাড়া করে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট সংযোগের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে, যাতে বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। বিটিআরসির প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটি সাত বছরের মধ্যে ব্রেক-ইভেন লেভেল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং নিয়ন্ত্রককে অন্যান্য দেশগুলোতে অতিরিক্ত ক্ষমতা বিক্রি করার অনুমতি দেবে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ২৬ কেইউ-ব্র্যান্ড এবং ১৪ সি-ব্র্যান্ড মিলিয়ে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়ার জন্য রাখা হবে। মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া দেশের বাইরে সম্পন্ন হলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। স্যাটেলাইটটি নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের মতো দেশে ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করা সম্ভব হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের নতুন যুগের সূচনা হবে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-রিসার্চ, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। বিশেষ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। এমন প্রতিকূল পরিবেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। দেশের গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের ডিজিটাল ডিভাইড বা পার্থক্য কমিয়ে আনতে পারবে এই স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্রডকাস্টিং এবং টেলিকমিউনিকেশন সুবিধা পৌঁছে দিতে পারবে। দেশে চালু হবে আধুনিক এবং লাভজনক সব সার্ভিস যেমন ডাইরেক্ট-টু-হোম সার্ভিস। এই স্যাটেলাইটের ফলে নতুন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে এবং নতুন চাকরির সুযোগও তৈরি হবে। বিশ্বের স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর ৫৭তম দেশ হিসেবে পরিচিত হওয়ার ঐতিহাসিক দিনের অপেক্ষায় ক্ষণগণনা চলছে। ২০১৫ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ নির্মাণ চুক্তির পর কথা ছিল ২০১৭ সালেই সেটি মহাকাশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সে বছরও উৎক্ষেপণের নির্ধারিত দিনও পার হয়ে যায়। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চ প্যাড থেকে ১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল চারটায় (বাংলাদেশ সময় ১১ মে, রাত ৩টা) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে মহাকাশে পৌঁছে দিতে উড়াল দেবে স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেটের একটি নতুন সংস্করণ। সূত্র : স্পেসএক্স, বিবিসি
×