ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদসংখ্যা তরুণদের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ১১ মে ২০১৮

ঈদসংখ্যা তরুণদের ভাবনা

দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক, পাক্ষিক, ছোটকাগজ, অনলাইন এবং ওয়েবম্যাগ ছাড়াও বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ঈদসংখ্যা। উৎসব কেন্দ্রিক দুটি সংখ্যা অনেক জল্পনা-কল্পনার ফসল। তবে একদিনেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ঈদসংখ্যা। কালের পরিক্রমায় শ্রম-ঘামের মিশ্রণে অবশ্য কর্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ব্যয়বহুল কাজটি। আর এই ঈদসংখ্যার ধারণা আসে মূলত কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার পূজা সংখ্যা থেকে। বাংলাদেশে এই চর্চাটি প্রথম নিয়ে আসে সম্ভবত ‘বেগম’ পত্রিকা। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক, পাক্ষিক, অনলাইন, ছোটকাগজ, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য সংগঠন প্রতিবছর ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে আসছে। প্রথিতযশা লেখকদের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিশীল সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকরাও যুক্ত হতে থাকেন এ যাত্রায়। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ যেমন ব্যয়বহুল; তেমনই সময়সাপেক্ষও বটে। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিশ্রমের ফলস্বরূপ হাসি ফোটে সম্পাদক, লেখক ও পাঠকের মুখে। ঈদসংখ্যার যাত্রা শুরুর পর থেকেই প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, বিচিত্র বিষয়ের সমন্বয়ে পাঠকের সামনে হাজির হতে থাকে একেকটি সংখ্যা। নতুনত্ব আনয়নের লক্ষ্যে নতুন নতুন ভাবনা যুক্ত হয় এর সঙ্গে। সে ভাবনায় যুক্ত হয় সমকালের তরুণ কবি-লেখকরাও। তরুণদের স্পর্শে তারুণ্য বিরাজ করে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার এ বিশাল মাধ্যমে। এ বাংলায় বড় দুটি উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা সাহিত্য গোষ্ঠীর উদ্যোগে এ দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশেষ আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রকাশিত সেসব আয়োজনের নাম দেওয়া হয় ‘ঈদসংখ্যা’। ঈদসংখ্যায় স্থান পায় গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, আত্মজীবনী, গবেষণা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, খেলাধুলা, সংস্কৃতি, বিনোদন, রান্নাবান্না, সাজগোছ প্রভৃতি বিষয়। বৃহৎ কলেবরের এ আয়োজন নিয়ে প্রতিটি সংখ্যা ঈদের আগেই পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। তবে একদিনেই তৈরি হয়ে যায় না একটি ঈদসংখ্যা। এত বড় আয়োজনের কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে দীর্ঘ একমাসেরও বেশি সময় ধরে। রমজান মাস শুরুর আগেই লেখা সংগ্রহ করতে থাকেন সংশ্লিষ্ট সম্পাদকগণ। তাদের সহযোগিতার জন্য নিবেদিত হন একঝাক তরুণ সাহিত্যকর্মী। বলতে গেলে নবীন-প্রবীণ মিলেই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে একটি ঈদসংখ্যা। এতো গেল আয়োজকদের কথা। আর যারা ঈদসংখ্যার জন্য লেখেন; তাদের প্রস্তুতি চলে প্রায় ছয়মাস আগে থেকেই। কখনো কখনো আরো বেশি সময় লাগতে পারে। যেমন একটি উপন্যাসের জন্যই অনেকের বছরের পর বছর লেগে যায়। ঈদসংখ্যার ইতিহাস খুঁজলে প্রথমেই আসে নূর জাহান বেগম সম্পাদিত ‘বেগম’ পত্রিকার ঈদ নিয়ে বিশেষ আয়োজনের কথা। ১৯৪৮ সালে কলকাতা থাকাকালীন ঈদ নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করা হয়। তিনি অবশ্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কলকাতার কিছু পত্রিকার পূজা সংখ্যা দেখে। এরপর ঢাকায় এসে ১৯৫১-৫২ থেকে আবার ‘বেগম’র বিশেষ ঈদসংখ্যা বের হয়। ‘বেগম’ বরাবরই লেখিকাদের ছবি দিয়ে ঈদসংখ্যা প্রকাশ করতো। এতে লেখিকারা পরস্পরকে চিনতে পারতেন, জানতে পারতেন। ঈদসংখ্যা সম্পর্কে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একবার লিখেছিলেন, ‘আমার ছেলেবেলা অবশ্য এ রকম পাঠ্য (এবং দেখ্য) একটি ঈদসংখ্যা ছিল, তবে সেটিকে ‘ঈদসংখ্যা’ বলা হতো না, ‘ঈদ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন’ ধরনের কিছু বলা হতো। সেটি ছিল বেগম পত্রিকার ঈদ উপহার।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার মা বেগম কিনতেন, আমরা ছিলাম বেগম-এর দলে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ এবং অন্যান্য কিছু ম্যাগাজিনের পূজাসংখ্যা তখন সিলেটেও পাওয়া যেত। মা সেগুলো পড়তেন। এই পূজাসংখ্যাগুলোই পরে আমাদের ঈদসংখ্যাগুলোর আত্মপ্রকাশের পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই।’ তৎকালীন বেগম পত্রিকাটি শিক্ষিত সব পরিবারের পাঠ্য ছিল, ঈদসংখ্যাটি তো বটেই। তখনকার ঈদসংখ্যার বাড়তি আকর্ষণ ছিল কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে প্রায় সব লেখিকার পাসপোর্ট সাইজের ছবি। যেহেতু প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল তখনকার লেখিকাদের কাগজ। সাদা-কালো হলেও সংখ্যাটি ছিল দেখার মতো। সে সময়ে অবশ্য ফ্যাশন নিয়ে কেউ ভাবতেন না। কারণ তখন ফ্যাশন করাকে বেহায়াপনার সমার্থক মনে করা হতো। ফলে বেগমের পাতায় কোনো মডেলের চাকচিক্যময় বা হৃদয়হরণ করার মতো কোনো ছবি ছিল না। পরবর্তীতে শাহাদত চৌধুরীর ‘বিচিত্রা’, মোস্তাফা জব্বারের ‘নিপুণ’ ঈদসংখ্যার দিকে এগিয়ে আসে। তখন ঈদসংখ্যায় সাহিত্যেরই প্রাধান্য ছিল। তবে এখন নানাবিধ বিষয় যুক্ত হয়েছে যুগের বা পাঠকের চাহিদাকে চিন্তা করে। একথা সত্য যে, ঈদসংখ্যায় এখনো সাহিত্যই প্রধানÑ সাহিত্যই জুড়ে থাকে এদের সিংহভাগ। বাংলাদেশে কেবল দৈনিক পত্রিকাগুলোই ঈদসংখ্যা করে না। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও ঈদসংখ্যা করছে। এমনকি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগগুলোও এ আয়োজনে পিছিয়ে নেই। এছাড়া কোনো কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকেও ঈদ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করতে দেখা যায়। সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রিন্টেড সংখ্যার পাশাপাশি ওয়েবসংখ্যাও হচ্ছে। হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক সংখ্যাও। সেক্ষেত্রে প্রিন্টের খরচটি বেঁচে যাচ্ছে আয়োজকদের। সেখানে প্রবীণদের চেয়ে নবীনরাই এগিয়ে থাকে। অনেক প্রবীণ প্রিন্টেড সংখ্যা ছাড়া লেখাও দিতে চান না। অনলাইনে যেহেতু জায়গা নিয়ে ভাবতে হয় না, সেহেতু মানসম্মত লেখা হলেই অনায়াসে প্রকাশিত হচ্ছে লেখাটি। ফলে প্রবীণ-তরুণদের সংমিশ্রণে ঈদসংখ্যাও হয়ে উঠছে সমৃদ্ধ। তবে প্রিন্টেড সংখ্যাটিও আবার অনলাইনে অবমুক্ত করে দেওয়া হয়। এমনকি ই-পেপার আকারেও সেটি পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে প্রবীণদের এ আয়োজনে তরুণদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি লেখালেখিতেও সমৃদ্ধ হয় সংখ্যাটি। কখনো কখনো তরুণদের সৃজনশীল পরিকল্পনাকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন কর্তৃপক্ষ। প্রচার-প্রসারে তরুণরাই পাঠকের কাছে নিয়ে যান একেকটি ঈদসংখ্যা। কবি-লেখকদের ঈদ আনন্দে বাড়তি অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে ঈদসংখ্যা। এ নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতাও তৈরি হয় নিজেদের মধ্যে। তরুণরা কে কয়টি ঈদসংখ্যায় নিজের লেখা প্রকাশ করতে পেরেছে, তা নিয়ে চলে উষ্ণ প্রতিযোগিতাও। কেউ কেউ আবার পুরোটাই বিমুখ হয়ে থাকেন এ আয়োজন থেকে। কখনো কখনো প্রবীণদের লেখার ভিড়ে জায়গা পেতেও হিমশিম খেতে হয় তাদের। কেউ কেউ জায়গা পেলেও প্রকাশের পরে লেখক সম্মানী থেকে বঞ্চিত হন। এ নিয়েও ঈদ পরবর্তী সময়ে আক্ষেপের সুর বেজে ওঠে। সব সম্ভাবনার পেছনে একটি অপশক্তি থাকে; যা সম্ভাবনাটাকে পেছনে টেনে ধরতে চায়। বাধাগ্রস্ত করতে চায় সৃজনশীলতার বৃহৎ সফলতাকে। তাই তরুণদের ভাবনায় ঈদসংখ্যা কেমন হওয়া উচিত? এ বিষয়ে ভাবা হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। তরুণদের কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়? এ বিষয়েও ভাবা হচ্ছে আজকাল। তবে এমন প্রশ্নের জবাবে অনেক তরুণ আক্ষেপও প্রকাশ করেন। অপেক্ষাকৃত বঞ্চিতরা দাবি করেন, প্রবীণ হলেই কি তার সব লেখা মানসম্মত হয়? প্রবীণ বলেই তার দুর্বল লেখা প্রকাশ করতে হবে কেন? তার চেয়ে তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের মানসম্মত লেখাকেও স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর লেখা প্রকাশিত হলে অবশ্যই সম্মানীটাও দেওয়া উচিত। প্রকাশের যোগ্য হলে সম্মানী পাওয়ারও যোগ্যতা তার রয়েছে। কখনো আবার তরুণরা দাবি করেন, ঈদসংখ্যাটি গাম্ভীর্যপূর্ণ না করে আরও আনন্দময় করা যেতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, ঈদসংখ্যার পাঠক প্রবীণদের চেয়ে তরুণরাই বেশি। তরুণরা প্রতিটি ঈদসংখ্যা শুধু পড়েনই না। তারা সংগ্রহও করে রাখেন। তাই তরুণদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এমনও হতে পারে, একজন প্রবীণের লেখা দশটি ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হলো। তিনি নিজেও এতগুলো সংখ্যার হিসেব রাখতে পারলেন না। এমনকি সংগ্রহ করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। এর চেয়ে একজন তরুণ লেখকের লেখা প্রকাশিত হলে প্রচার-প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাই ঈদসংখ্যা হতে পারে তারুণ্য নির্ভর। কিংবা তরুণদের মুখপাত্র হোক ঈদসংখ্যা। এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন তরুণ কবি, কথাশিল্পী, নির্মাতা, নাট্যকারের সঙ্গে কথা হয়। ধানশালিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশা বলেন, ‘প্রাসঙ্গিক ব্যাপার হলো; যে কোনো পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনের ঈদসংখ্যার প্রতি সাধারণ পাঠকের আলাদা একটা আগ্রহ থাকে; যা সারা বছরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই যে কোনো পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের ঈদসংখ্যা হওয়া উচিত সময়োপযোগী এবং পাঠোপযোগী। আর একটা বিষয় খেয়াল রাখা উচিত, ঈদসংখ্যা মূলত কবি-সাহিত্যিকদের লেখায়ই সমৃদ্ধ হয়ে থাকে; তাই আমার মনে হয়Ñএখানে নবীন, প্রবীণ সবার অংশগ্রহণ থাকা অতীব জরুরি। কারণ তাদের মাঝে একটা যূথবন্ধন তৈরি হবে, যা বাংলা সাহিত্যের জন্য মঙ্গলজনক।’ তরুণ কবি ও কথাশিল্পী মুহাম্মদ ফরিদ হাসান বলেন, ‘ঈদসংখ্যায় লেখার ইচ্ছে আমার দীর্ঘদিনের ছিলো। অনেকের কাছে শুনতামÑ তরুণরা ঈদসংখ্যায় লেখার সুযোগ পায় না। কিন্তু কথাটি যে সত্য নয়; তা আমি কিছুদিন পর প্রমাণ পেলাম। আমি গত তিনবছর ধরে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের ঈদসংখ্যায় লিখছি। তবে একথা সত্য যে, জাতীয় দৈনিকের ঈদসংখ্যায় তরুণদের সুযোগ তুলনামূলক কম থাকে। সেক্ষেত্রে যদি তরুণদের আরো বেশি সুযোগ দেওয়া যায়, তবে সাহিত্য উপকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।’ সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ কালকূট সম্পাদক রাসেল রায়হান বলেন, ‘আমি ঈদসংখ্যা চাই এমনÑ যেখানে আগেই লক্ষ্য থাকবে না যে, নির্দিষ্টসংখ্যক পৃষ্ঠা ভরাট করতে হবে। বরং হাতে যতগুলো লেখা আসে, সেখান থেকে ভালো লেখাগুলোই রাখা হোক। সেক্ষেত্রে এমনও করা যেতে পারেÑ সাহিত্যপাতার জন্য যে লেখাগুলো আসে, সেখান থেকে বিশেষ কোনো লেখা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই সেটা লেখককে জানিয়ে ঈদসংখ্যার জন্য রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দু’মাস নয়, আরও আগে থেকেই মাথায় রাখতে হবে ঈদসংখ্যার বিষয়টা। এছাড়া ঈদসংখ্যায় তরুণদের প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। সাধারণত সিনিয়রদের লেখাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, কিন্তু সেটা স্বাভাবিকও। স্বাভাবিক দেখেই বিষয়টি গতানুগতিক হয়ে দাঁড়ায়। একটু অন্যরকম না হলে এই সময়ে ঈদসংখ্যার কোনো মানে নেই। করার জন্য করা হলে সেটা ¯্রফে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের অস্ত্র এবং ঘর সাজানোর বস্তুতে পরিণত হয়।’ ছোটকাগজ কবি কথনের সম্পাদক সাফিনা আক্তার বলেন, ‘দয়াকরে আকারে শুধু শুধু বিশাল করবেন না। বিশালত্বের গুরুত্বও দিতে হবে। বিখ্যাতদের লেখাই শুধু ছাপাবেন না। ছোটদের (নবীন বা তরুণ) স্থান দিন। যারা প্রতিশ্রুতিশীল; তাদের লেখার কদর করা হোক। তাহলেই ঈদসংখ্যা সত্যিকারার্থে আনন্দসংখ্যায় রূপান্তরিত হবে।’ তরুণ কবি রিক্তা রিচি বলেন, ‘আমার মতেÑ প্রতিটি ঈদসংখ্যা হওয়া দরকার সমৃদ্ধ। অর্থাৎ সেখানে প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের লেখার প্রাধান্য থাকবে। জাতীয় দৈনিক, অনলাইন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের প্রতিটি ঈদসংখ্যায় যেন ঈদের আমেজ, উৎসব মুখরতার ব্যাপারটি বজায় থাকে। যে কোনো সাধারণ মানুষ ঈদসংখ্যাটি হাতে নিলেই যেন ঈদের আমেজ পেতে পারে; সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। আর অবশ্যই লেখার মানের দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।’ কবি ও কথাশিল্পী মাহমুদ নোমান বলেন, ‘অযথা বড় লেখকদের বস্তাপচা লেখা না ছাপিয়ে তারুণ্যনির্ভর এবং প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের দাপটের একটি ঈদসংখ্যা করা হোক। যেন অসহায় লেখকের মুখেও হাসি ফোটে। কেবল নাম দেখে নয়, যোগ্য লেখায় ভরা, সাজানো-গোছানো, মনকাড়া হোক প্রতিটি ঈদসংখ্যা। যোগ্য তারুণ্যের হাতেই হোক এমন কিছু।’ ঈদকে আরো বেশি সার্বজনীন কীভাবে করা যেতে পারেÑ এসব বিষয়ও থাকতে পারে।’ তরুণ লেখক, উপস্থাপক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইন বলেন, ‘ঈদসংখ্যা হওয়া উচিত আনন্দময়। সেটি সব পরিসরের মানুষের জন্যই। সবাই তো আর সাহিত্যে আনন্দ খুঁজে পান না। কেউ সিনেমায় আনন্দ খুঁজে পান, কেউ খেলাধুলায় আনন্দ পান, কেউ হয়তো অন্যকিছুতে। যেহেতু আনন্দ দেওয়াই সবার উদ্দেশ্য। তাই আমার মনে হয়, সব বিষয় মাথায় রেখে সর্বস্তরের পাঠকের জন্যই ঈদসংখ্যা হওয়া উচিত।’ শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিথুন বলেন, ‘ঈদসংখ্যাতে শিশুসাহিত্যেরও প্রাধান্য থাকুক। বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও যেন তা পড়তে পারে। শিশুদের জন্য একটি অংশ বরাদ্দ করা যেতে পারে। সে দাবির পাশাপাশি নৈতিক একটি দাবি হচ্ছে- অবশ্যই তরুণদের লেখক সম্মানী দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে। প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমরা তাদের সমকক্ষতা দাবি করছি না; শুধু আমাদের প্রাপ্যটা দাবি করছি।’ তবে এ কথা সত্য যে, তরুণরা লেখা প্রকাশের প্রতি জোর দিলেও লেখক সম্মানীর ব্যাপারে খুব বেশি আক্ষেপ প্রকাশ করেননি। দু’একজন শুধু বলেছেন লেখক সম্মানীর কথা। কিন্তু অস্বীকার করারও উপায় নেই যে, একজন তরুণ লেখক সম্মানী পেলে আরো বেশি উৎসাহী হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিছুটা আক্ষেপের সঙ্গেই বলতে হয়, প্রতিষ্ঠিত লেখকের জন্য সম্মানী বরাদ্দ থাকলেও তরুণদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে হয়। অনেকটা এমন যে, তোমার লেখা ছেপেছি; সেই বা কম কিসের? অথচ লেখার তৈরির ক্ষেত্রে উভয়েরই সমান পরিশ্রম, মেধা এবং সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। লেখক সম্মানী নিয়ে সবসময়ই কমবেশি চাপা ক্ষোভ থাকলেও লেখা প্রকাশের স্বার্থে তরুণরা বিষয়টি চেপে যান। তারাও একদিন বড় লেখক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি আমলে নিয়ে এগিয়ে আসা দরকার। সম্মানীটা পরিমাণে কম-বেশিও হতে পারে। একজন প্রবীণের জন্য যা বরাদ্দ থাকে, তরুণের জন্য তার চেয়ে কম হলেও ক্ষতি নেই। অন্তত সান্ত¡নাটুকু তো সে পেতে পারে। বৃহৎ কলেবরের ঈদসংখ্যা ছাড়াও ছোট আকারের ঈদসংখ্যা করেন অনেকেই। যাকে অনেকটা ‘গরিবের ঈদসংখ্যা’ বলা যেতে পারে। এছাড়া শুধু বিনোদন কেন্দ্রিক ঈদসংখ্যাও হচ্ছে। তবে শিশুদের জন্য আলাদা বৃহৎ ঈদসংখ্যা খুব কমই চোখে পড়ছে। শিশু সংক্রান্ত কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিশুতোষ পত্রিকা বা সংস্থা ছাড়া তেমন কেউ শিশুদের ঈদসংখ্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন না। তাই বলা যেতে পারে, অন্তত এই বৃহৎ আয়োজনের মধ্যে শিশুতোষ গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, গোয়েন্দা কাহিনী প্রকাশ করা যেতে পারে। মূল কথা হচ্ছেÑ একটি ঈদসংখ্যা হোক সার্বজনীন। সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনুক। হাসি ফুটুক প্রকাশক, সম্পাদক, লেখক ও পাঠকদের মুখে। প্রকাশক এবং সম্পাদকের পাশাপাশি লাভবান হোক লেখকরাও। ‘বিনা পয়সায় লেখা পাওয়া যায়’ সংস্কৃতিটা বন্ধ করা একান্ত জরুরী। অন্তত ঈদ উপলক্ষে শুরু হোক সবার জন্য সালামি। লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও চনমনে হয়ে উঠুক সম্মানে। প্রবীণ-তরুণ বিবাদের অবসান হোক। লেখার গুণগত মানই হোক প্রকাশের হাতিয়ার। স্বজনপ্রীতির করাল গ্রাসে সাহিত্যের বারোটা না বাজিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হোক। একজন সম্পাদকের হাত ধরেই উঠে আসুক একজন সম্ভাবনাময় লেখক। আবিষ্কার হোক নতুন কেউ। পুরনো চালে ভাত না বাড়িয়ে নতুন চালেও চেষ্টা করা যেতে পারে। নতুনের হাতেই উঠে আসতে পারে কালজয়ী কোনো সাহিত্যকর্ম। তাই জহুরির মতো আগে সোনা চিনতে হবে। রুপার গায়ে সোনার প্রলেপ দিয়ে কতকাল টিকিয়ে রাখা যায়? আমরা সবাই জানি- ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেবে ঈদসংখ্যা। ঈদসংখ্যার প্রচার-প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। প্রত্যেক লেখকের সংগ্রহ করা উচিত নিজ দায়িত্বে। ঈদসংখ্যা বিক্রি না হওয়ার অপবাদ ঘোচানোর দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। আন্তরিক হতে হবে আমাদের। সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদার চিত্তে এগিয়ে আসতে হবে। দাঁড়াতে হবে একে অপরের পাশে। সাহিত্যচর্চা যেন আমাদের ফতুর না করে- এটি এখন সময়ের দাবি। সবশেষে আশা করবো, ঈদসংখ্যার ইতিহাস আরো দীর্ঘ হোক। জয় হোক বাংলা সাহিত্যের। জয় হোক ঈদসংখ্যার।
×