ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভর দুপুরেই মধ্যরাতের আঁধার

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ মে ২০১৮

ভর দুপুরেই মধ্যরাতের আঁধার

শাহীন রহমান ॥ বৃহস্পতিবার সকালের আকাশটা ছিল বেশ পরিষ্কার। চারদিকে রোদ ঝলমল আলোকোজ্জ্বল পরিবেশ। সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় ছিল না আকাশে মেঘের আনাগোনা হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুতই বদলে যেতে থাকে। এগারোটা নাগাদ চারদিকে ঘনিয়ে আসে সাঁজের আঁধার। ঘনকালো মেঘে ঢেকে যায় সারা আকাশ। দিনের পরিবেশ দেখে মনে হয় বুঝিবা কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতের দৃশ্য। শুধু বৃহস্পতিবারই নয়, এবার আকাশের কালবৈশাখীর মেঘ জমলেই প্রায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। বৈশাখের মেঘে চারদিকে কেন এমন অন্ধকার নেমে আসছে? আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন কালবৈশাখীর মেঘের ধরনটাই এমন। এই মেঘের ঘনত্ব অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। ফলে যখন মেঘ হয় তখন আকাশে এমন একটি পজিশন তৈরি করে যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণত এই সময়ে আকাশের অনেক উপরে কালবৈশাখীর মেঘ জমে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে মেঘের ঘনত্ব থাকে। মেঘের এই অধিক ঘনত্বের কারণে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। তবে এই পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। দ্রুতই এই পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং চারদিক আবার পরিষ্কার হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বৈশাখ মাসের মেঘ সাধারণত পুরু ও ভারি হয়। এ কারণে ওই ভারি মেঘের স্তর ভেদ করে ভূপৃষ্ঠের দিকে সূর্যের আলো আসতে না পারায় মেঘগুলো কালো দেখায়। গবেষকদের মতে, এ ধরনের মেঘের পুরুত্ব ৩ হাজার ফুট পর্যন্ত হতে পারে যা সূর্যালোকের পক্ষে ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। বৃহস্পতিবার সকালের কালো মেঘ এমন আকার ধারণ করে যে দিনের আলো উবে গিয়ে প্রকৃতিতে অন্ধকার নেমে আসে। যেন অমাবস্যা রাতের কোন দৃশ্য। পরিবেশ দেখে নগরবাসীর মনও দুরু দুরু করতে থাকে কি জানি কি হয়। হুট হাট নেমে আসা রাতের আঁধার কিছুটা উৎকণ্ঠায় ফেলে তাদের। কিন্তু সকালের এই পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সকাল এগারোটার দিকে অন্ধকার নেমে এলেও সাড়ে ১১টার পরেই চারদিকে পরিবেশ আবার পরিষ্কার হয়ে যায়। আকাশে রোদের দেখা মেলে। পরিবেশ দেখার বোঝার কোন উপায় ছিল না কিছুক্ষণ আগে প্রকৃতিকে এমন অন্ধকার বিরাজ করেছিল। এদিন শুধু রাজধানী ঢাকাতে নয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘনকালো মেঘের কারণে চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। সকাল আটটা থেকে নয়টার মধ্যে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় এমন মেঘ তৈরি খবর পাওয়া যায়। শুধু যে বৃহস্পতিবারেই এমন মেঘ তৈরি হয়েছে তা নয়। এ বছরের কালবৈশাখীর শুরুতেই প্রায় এমন ধরনের মেঘের দেখা মিলছে। যেখানেই হঠাৎ চারদিকে পরিবেশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই আবার তা স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। গত ৩০ এপ্রিল সকাল এগারোটায় রাজধানীতে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ওইদিন সকাল থেকেই আকাশে জমতে থাকা খ- খ- কালো মেঘ। বেলা একটু বাড়তে থাকলে আকাশে রোদের শেষ রেখাটুকুও মিলিয়ে যায়। ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় ঢাকার আকাশ। সাড়ে এগারোটার দিকে চারদিকে নেমে আসতে শুরু করে রাতের আঁধার। ১০ মিনিটেই আঁধারে ঢেকে যায় সারা ঢাকা। এক ঘণ্টা বৃষ্টিপাতের পরই আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। বিকেলে পরিবেশ ভিন্ন রূপ ধারণ করে। মনে হয় যেন আগে বৃষ্টিপাতই হয়নি। গত ২ মে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকেও এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কালো পর্দার মতো ঘনকালো মেঘের স্তরে ঢাকা পড়ে ঢাকার আকাশ। বাসা-বাড়িতে জ্বলে ওঠে বাতি। সড়কে বাধ্য হয়ে মোটরযানগুলো জ্বালায় আলো। গত ৩০ মার্চও ঢাকার আকাশ ঢেকে যায় ঘন কালো মেঘে। ওইদিনও ঝলমলে তপ্ত দুপুরের পরে বিকাল নামতেই বদলে যায় ঢাকার আকাশ। ছেয়ে যায় ঘনকালো মেঘে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বৈশাখ মাসে সাধারণত কয়েক স্তরের মেঘ হয় আকাশে। এ সময় এক স্তরের মেঘের ওপর আরেক স্তরের মেঘের ছায়া পড়লে ছায়াযুক্ত মেঘকে কালো দেখায়। এ ছাড়া তারা বলেন এই সময়ে আকাশে যে মেঘ তৈরি হয় তাকে কিউমুলোনিম্বাস বা পুঞ্জীপূর্বক মেঘ বলা হয়ে থাকে। এই মেঘ আকাশে ৪৫ হাজার ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠে যায়। আর এই দূরত্বের কারণে মেঘের রং ধূসর হলেও দূরত্বের কারণে তা কালো দেখায়। এই সময়টা শুষ্ক বলে বাতাসে ধূলিকণার সংখ্যাও অনেক বেশি থাকে। ফলে আকাশের দিকে আমাদের দৃষ্টিসীমা কমে আসে অনেকটা। ধূলিকণার কিছু মেঘের সঙ্গেও মিশে যায়। আর সেসব ধূলিকণা জলের সঙ্গে মিশে ধূসর থেকে হয়ে যায় কালো। আর এ কারণেই বৈশাখ মাসে মেঘ কালো হয়, কখনও কখনও ভরদুপুরে নেমে আসে রাতের আঁধার। শাহ আলম বলেন আসলে কালবৈশাখীর মেঘের ধরনটাই এমন। অনেক উপরে যেম মেঘ সৃষ্টি হয। মেঘের ঘনত্ব অন্য সময়ে চেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, বন্যায় মেঘ থাকে অনকে নিচুতে। কিন্তু মেঘের ঘনত্ব বৈশাখীর মেঘের মতো হয়। সাধারণ ৫শ’ থেকে ১ হাজার ফিটের মধ্যে মেঘের ঘনত্ব থাকে। ঘনত্ব কম হওয়ায় বর্ষা সময় বা অন্য সময়ে আকাশে মেঘ হলে এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। কিন্তু বৈশাখীর মেঘের ধরনটা অন্য সময়ের মেঘের চেয়ে আলাদা হওয়ায় অন্ধকার নেমে আসে চারদিকে। এবারে কালবৈশাখী মেঘ এবং ঝড়ের প্রভাব নিকট অতীতের যে কোন বছরে তুলনায় অনেক বেশি। বৈশাখ শুরু হওয়ার আগেই ঝড়ের তা-বে দেশের অনেক এলাকায় লণ্ড ভণ্ড করে দেয়। তেমনি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। সঙ্গে বজ্রঝড় তো রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন সাগরে নিম্নচাপ না থাকায় স্থলভাগের ঝড়ে প্রভাব বেশি হচ্ছে এবার। প্রতি বছর এই সময়ে সাগরের একাধিক নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। গত বছরও এই সময়ে একাধিক নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। ৩০ মে ঝড়ে মৃত্যু হয় ৮ জনের বেশি। তারা জানান সাগরে নিম্নচাপ হলে এর প্রভাব পড়ে স্থলভাগের ওপর। ফলে উত্তর পশ্চিম কালবৈশাখীর প্রভাব কম থাকে। এবার নিম্নচাপ না থাকায় কালবৈশাখীর প্রভাব বাড়ছে বলেও তারা উল্লেখ করেন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়ন বেড়ে যাওয়া কারণে ঝড়ের তীব্রতা আগের চেয়ে বেশি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে কালবৈশাখী এক ধরনের বজ্রঝড় যা সচরাচর এপ্রিল-মে (বৈশাখ) মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কালবৈশাখী অর্থ কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ। ঘন, কালো বর্ণের মেঘ ও ঝঞ্ঝা এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্যই এ নামকরণ। স্থানীয়ভাবে কোনো এলাকার ভূপৃষ্ঠ অত্যধিক তাপমাত্রা অথবা অন্যান্য কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বায়ুম-ল যথেষ্ট অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং এ ঝড়ের জন্ম হয়। উত্তপ্ত, হাল্কা ও অস্থির বায়ু উর্ধ্বমুখী উঠতে থাকে। বায়ুম-লের অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে কিউমুলাস মেঘ উলম্বভাবে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ গঠন করে এবং পরবর্তী সময়ে বজ্রঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয় যা সকালবৈশাখী নামে পরিচিত। তারা বলেন মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশের তাপমাত্রা আগের মাসের তুলনায় দ্রুত বাড়তে থাকে। এ সময় দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের দৈনিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বায়ুম-লের নিম্ন স্তরের উষ্ণ এবং আদ্র বায়ুর উপস্থিতিই এই কালবৈশাখী সৃষ্টি করে থাকে। এদিকে বৃহস্পতিবারের সকালের ঘনকালো মেঘের কারণে দেশের বিভিন্ন রুটে নৌযান চলচল বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। পরে আবহাওয়ার অবস্থার উন্নতি হওয়ায় রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে নৌযান চলাচল শুরু করে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা নৌ চলাচল বন্ধ থাকার পর বেলা সোয়া ১২টা থেকে নৌযানগুলো সদরঘাট ছাড়তে শুরু। এর আগে সকালের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বৃহস্পতিবার সাড়ে ১০টায় সদরঘাট থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
×