ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবেশ করছে স্যাটেলাইট যুগে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের কথা নিয়ন্ত্রণ করা হবে গাজীপুর থেকে আয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা স্যাটেলাইট পাঠানোর তালিকায় স্থান হবে ৫৭তম

এবার মহাকাশে পা ॥ আরেক স্বপ্ন পূরণ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১১ মে ২০১৮

এবার মহাকাশে পা ॥ আরেক স্বপ্ন পূরণ

ফিরোজ মান্না ॥ আরও একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এর মাধ্যমে মহাকাশে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করার কথা। সব ঠিক থাকলে ভোর রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার কথা জানা গেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে। ভূমি থেকে ছাড়ার পর টানা ৮ দিন মহাকাশে উড়ে ৩৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিজস্ব কক্ষপথে নিজের অবস্থানে স্থাপন হবে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হবে বাংলাদেশ। এটা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নিয়ে সারাদেশে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। তথ্য প্রযুক্তি খাতে নবযুগে প্রবেশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল। বিশেষ করে প্রযুক্তিপ্রিয় তরুণ সমাজ গভীরভাবে দৃষ্টি রাখে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দিকে। রাজধানীসহ সারা দেশে শোভা পাচ্ছে বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্য জনসাধারণকে দেখার সুব্যবস্থা করার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ। প্রবাসীরা জড়ো হন কেন্দ্রের কাছে। বাংলাদেশ থেকে অনেক মিডিয়াও যোগদান করে এই উৎসবে। বিটিআরসি জানিয়েছে, ৩ দশমিক ৭ মেট্রিক টন ওজন নিয়ে টানা ১৫ বছর অবস্থান করবে এটি। ১৫ বছর চলে যাওয়ার পর স্যাটেলাইট আরও ৩ বছর বার্তা দিতে পারবে। তবে ওই তিন বছরকে ‘লাইভ টাইম’ ধরা হয়নি। স্যাটেলাইট নির্মাণের এই মহাকর্মযজ্ঞে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিয়েছে এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিদেশী ঋণে নির্মিত হয়েছে। নিজস্ব কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপন করা হবে স্যাটেলাইটটি। গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০ থেকে ২২ দিন সময় লাগবে। গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দু’টি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হবে। দেশের গ্রামাঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা হবে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনা, কেবল টিভি সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম)সহ জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন। এটা আরেকটি স্বপ্ন পূরণ। বিশ্বের যে ৫৬ দেশ এতদিন স্যাটেলাইটের মালিক হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলেছে। আজ থেকে ৫৭-তম দেশ হিসেবে আমরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়ালাম। আমাদের মাথাও আজ তাদের সারিতে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট টেলিযোগাযোগ সেক্টরকে উন্নত থেকে উন্নততর জায়গায় নিয়ে যাবে। আজ থেকে কেবল টিভিকে অন্য দেশের স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। নিজের দেশের স্যাটেলাইট থেকেই ব্যান্ডউইথ পাওয়া যাবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশ বহু গুণে এগিয়ে যাবে। ২০২১ সালের আগেই দেশ ডিজিটাল হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্মের একটা ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে স্যাটেলাইট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে ১৯৯৮ সালে স্যাটেলাইট সংক্রান্ত একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির আমি একজন সদস্য ছিলাম। সেই সময় বিটিটিবি বর্তমানে বিটিসিএল’র একজন কর্মকর্তাকে ফ্রান্সে পাঠানো হয় স্যাটেলাইট সম্পর্কে জানতে। তিনি ফ্রান্সে ঘুরে এসে একটি নেতিবাচক রিপোর্ট দেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল এটি একটি ব্যয়বহুল কাজ। এটা করতে বিরাট অংকের টাকার প্রয়োজন হবে। এরপরও তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেন, একদিন বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের মালিক হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। রাতেই মহাকাশে যাচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহূর্তটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব ক’টি বেসরকারী টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচারের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাবে, আনবেও -পলক ॥ দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য বিদেশী স্যাটেলাইট ব্যবহার করায় যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়, ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইট চালু হলে তা বেঁচে যাবে বলে মন্তব্য করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। পাশাপাশি দেশের প্রথম এই কৃত্রিম উপগ্রহের বাড়তি সক্ষমতা ভাড়া দিয়ে বিদেশী মুদ্রা আয়ও হবে বলে মনে করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঐতিহাসিক মুহূর্তের আগে এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। বিবৃতিতে পলক বলেন, সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বর্তমানে বাংলাদেশের সব টিভি চ্যানেল তাদের সম্প্রচারের জন্য বিদেশী স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর টিভি চ্যানেলগুলোর বিদেশ নির্ভরতা যেমন কমে আসবে তেমনি সাশ্রয় হবে মহামূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। আমরা আমাদের দেশের সব টিভি চ্যানেলের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের স্যাটেলাইট অন্যান্য দেশের টিভি চ্যানেলের জন্য ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করতে পারব। আমাদের স্যাটেলাইটে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। আমাদের বর্তমানে যে চাহিদা রয়েছে তা পূরণ করেও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে যে, অনন্ত ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশীদের জন্য ভাড়া দেব। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা দুর্গম পাহাড়ী এলাকা যেখানে ফাইবার অপটিক দিয়ে ইন্টারনেট সেবা দেয়া কঠিন, সেসব জায়গায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে খুব সহজেই পৌঁছানো সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি। পলক বলেন, ‘এর বাইরেও যোগাযোগ স্যাটেলাইট তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। দুর্যোগের সময় ভূমি কেন্দ্রিক যোগযোগ ব্যবস্থা অকার্যকার থাকলেও স্যাটেলাইট তখন কার্যকর থাকে। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে-পরেও স্যাটেলাইট যোগাযোগ খুবই ব্যবস্থা খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এই উদ্যোগের জন্য প্রতিমন্ত্রী পলক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূমিকার কথাও স্মরণ করেন। বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস এ্যালেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে ৩০ মার্চ উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। সেখানে আরেক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেস এক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে স্যাটেলাইটটিকে মহাকাশে পাঠানো হবে। স্যাটেলাইট তৈরি এবং ওড়ানোর কাজটি হয় বিদেশে। কিন্তু স্যাটেলাইটের সব নিয়ন্ত্রণ হবে বাংলাদেশ থেকেই। গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। আর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশনকে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহারে দেশীয় কেবল টিভির কোন সমস্যা হলে তা সমাধান করা হবে। স্যাটেলাইট তো দেশের মানুষের জন্যই। কারও যেন কোন অসুবিধা না হয় সেদিকটি বিটিআরসি অবশ্যই গুরুত্ব দেবে। ২০০৭ সালে মহাকাশের ১০২ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের কাছে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। পরে ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়। বিটিআরসি জানিয়েছে, জাতিসংঘের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস এ্যাফেয়ার্সের (ইউএনওওএসএ) হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৩৫। প্রতিবছরই স্যাটেলাইটের এ সংখ্যা ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এসব স্যাটেলাইটের কাজের ধরনও একেক রকমের। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি বিভিন্ন ধরনের মহাকাশ যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ‘জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট’। পৃথিবী ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরবে। দেশে প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারে আছে। এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুর-হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে সম্প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় ২০ লাখ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে ভাড়ার টাকা দেশেই থাকবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বা সক্ষমতা থাকবে ৪০টি। এর মধ্যে ২০ ট্রান্সপন্ডার দেশে ও বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশে ভাড়া দেয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, স্থানীয় সময় বিকাল চারটা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত দুইটা ১৫ মিনিটে) ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেপ কেনেডি সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে মহাকাশে উড়ে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। তিন মিনিটের মধ্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কাজ শেষ হয়। এরপর রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশের পথে যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে মর্যাদার আসনে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। স্যাটেলাইট ক্ষেপণ নিয়ে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। এই অর্জন বর্তমান সরকারকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিশ্বের শক্তিধর ও উন্নত দেশগুলোই কেবল স্যাটেলাইটের মালিক। বাংলাদেশের মত দেশ আজ উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে। জাতি হিসেবে এটা গর্বের বিষয়। গাজীপুরে গ্রাউন্ড স্টেশন প্রস্তুত ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর এটির নিয়ন্ত্রণ নিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তেলীপাড়ায় টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ সংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশনটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। আর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্যটি দেখার জন্য গাজীপুরে নেয়া হয় ব্যাপক প্রস্ততি। টিভিতে সরাসরি প্রচারিত এ বিরল দৃশ্যটি দেখতে অনেকে বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দা টানান। ইতিহাসের সাক্ষী হতে অনেকে রাত জেগে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের দৃশ্যটি দেখেন। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, উৎক্ষেপণের পর গাজীপুরে স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটিকে। এ ধরনের আরেকটি গ্রাউন্ড স্টেশন চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় স্থাপন করা হলেও এটি হচ্ছে গাজীপুরে স্থাপন করা গ্রাউন্ড স্টেশনের বিকল্প। মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হবে গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন। শীঘ্রই গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। উৎক্ষেপণের দৃশ্য সম্প্রচারে সরাসরি জেলার ক্যাবল অপারেটরদের নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন লাগবে। স্যাটেলাইটটি স¤পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে। এ উৎক্ষেপণ দেখতে হলে আগ্রহীদের উৎক্ষেপণ স্থানের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থান নেন। সাত মিনিটের কম সময় দেখা যায়, তার পরপরই উচ্চগতির রকেট চলে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ-১ খুলে নিচের দিকে নামতে থাকে, এরপর চালু হয় স্টেজ-২। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ পৃথিবীতে এলেও স্টেজ-২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যায়। দুইটি ধাপে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি হলো লঞ্চ এ্যান্ড আরলি অরবিট ফেইজ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে স্যাটেলাইট ইন অরবিট। এলইওপি ধাপে ১০ দিন এবং পরের ধাপে ২০ দিন লাগবে। উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে যাবে এই স্যাটেলাইট। ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যাবে। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল ¯পট) স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশের স্যাটেলাইটটিতে লেখা থাকবে বিবি এবং থাকবে একটি সরকারী লোগো। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাবে ॥ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ যোগাযোগ এবং সম্প্রচার কাজেই মূলত ব্যবহার করা হবে। এ স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার প্রায় ৩৬ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গের সমপরিমাণ। অর্থাৎ, ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থেকে পাওয়া যাবে প্রায় এক হাজার ৪৪০ মেগাহার্টজ পরিমাণ বেতার তরঙ্গ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট থেকে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। আর ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে। ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি হচ্ছে কেইউ ব্যান্ডের এবং ১৪টি সি ব্যান্ডের। গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় স্থাপিত দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। এর মধ্যে গাজীপুর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে এবং বেতবুনিয়া বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে পৃথক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কো¤পানি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিবছর অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে এ অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। ফলে বড় অঙ্কের টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। দেশের বেসরকারী টেলিভিশনগুলোর স্যাটেলাইট ভাড়া বাবদ ব্যয়ও কমে আসবে। এ ছাড়া স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ। ফলে ব্যান্ডউইথের বিকল্প উৎসও পাওয়া যাবে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও উদ্ধারকর্মীরা স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ রেখে দুর্গত এলাকায় কাজ করতে সক্ষম হবেন। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার ভুটান, নেপাল ও এশিয়ার অন্য অংশে কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তানের মতো দেশেও ভাড়া দেয়া যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে সমর্থ হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সুফল আসবে কবে ॥ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎক্ষেপণের পর মাস দুয়েক পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। এরপর সুফল পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, এটি উৎক্ষেপণের পর মাস দুয়েক পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। ওই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সফলতা পাওয়ার পর তা ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যাবে। বর্তমানে দেশের ৩০টি টিভি চ্যানেলকে উপগ্রহ খরচ বাবদ প্রতি বছর বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয় ১২৫ কোটি টাকা। নিজস্ব উপগ্রহ হওয়ায় এই টাকা সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট, ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০টি সেবায় ভূমিকা রাখবে। ভূমিকা থাকবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো নিরবচ্ছিন্ন রাখতেও। প্রকল্প পরিচালক মোঃ মেজবাহুজ্জামান জানান, উৎক্ষেপণের ৩০ দিনের মধ্যে এটি অরবিট বা কক্ষপথে পৌঁছাবে। দুটি ধাপে এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া শেষ হবে। উৎক্ষেপণের দিনটি বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিহাস হবে জানিয়ে তিনি বলেন, উৎক্ষেপণের পর সাধারণত এক মাস সময় লাগে। এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচারে বাংলাদেশ নতুন যুগের সূচনা হবে। এটি পরিচালনার জন্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের একটি প্রতিনিধি দলকে প্রশিক্ষিত করে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে মূল তত্ত্বাবধানে প্রথম তিন বছর সহায়তা করবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোয় বাংলাদেশ বিশ্বে ৫৭তম দেশ ॥ দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ কক্ষপথে পাঠানোর মাধ্যমে মহাকাশে যোগাযোগ উপগ্রহ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। আমেরিকান সংস্থা স্পেসএক্সের বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানভেরাল উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে স্যাটেলাইটটি কক্ষপথে পাঠানোর কথা। এর আগে ফ্লোরিডা থেকে ৪ মে বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের তারিখ নির্ধারিত করা হয়েছিল। তবে কারিগরি কারণে এই তারিখ পরিবর্তন করে ৭ মে করা হয়। পরে নতুন তারিখ শুক্রবার নির্ধারণ করা হয়। এটি গত ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণের কথা ছিল তবে কারিগরি এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এ ৪০ ট্রান্সপন্ডারস্ রয়েছে, যার ফলে স্যাটেলাইটটি সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, তুর্কমেনিস্তান, কাজাকিস্তান এবং তাজিকিস্তানেও সেবা দিতে পারবে। ফ্রান্সের কানে কয়েক মাস আগে থালেস এলিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিস কোম্পানি স্যাটেলাইটটি নির্মাণ করে তাদের হেফাজতে রাখে। এরপর গত ২৯ মার্চে স্যাটেলাইটি কক্ষপথে উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় নেয়া হয়। এর কেইউ-ব্যান্ড বাংলাদেশসহ বঙ্গোপসাগর, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। অপরদিকে এর সি-ব্যান্ড বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিমিস্তান এবং কাজাকিস্তানের একটি অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। বঙ্গবন্ধু-১ এর ফলে ডাইরেক্ট-টু-হো (ডিটিএইচ) ভিডিও সার্ভিস, ই-লার্নিং, টেলি-মেডিসিন, পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি খাতসহ দুর্যোগ উদ্ধারে ভয়েস সার্ভিসের জন্য সেলুলার নেটোয়ার্কের কার্যক্রম এবং এসসিএডিএ, এওএইচও এর ডাটা সার্ভিসের পাশাপাশি বিজনেস-টু-বিজনেস (ভিসেট) পরিচালনা আরও সহজতর করবে। দোয়া মাহফিল ॥ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার বাদ জোহর বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা মিজানুর রহমান। এ সময় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ এর উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে দেশের ভাবমূর্তি যেন আরও উজ্জ্বল হয় সেজন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া মোনাজাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করা হয়। দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করেও দোয়া করা হয়। মোনাজাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুসল্লিগণ উপস্থিত ছিলেন।
×