ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

ব্যক্তিগত আয়করের কয়েকটি বিকল্প আয়ের প্রস্তাব

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১১ মে ২০১৮

ব্যক্তিগত আয়করের কয়েকটি বিকল্প আয়ের প্রস্তাব

আয়কর আইন মোতাবেক যাদেরই করযোগ্য আয় আছে তাদেরই আয়কর নেয়া বাধ্যতামূলক। এখানে ওজর-আপত্তির কোন সুযোগ নেই। অসুস্থ, কষ্ট হচ্ছে, সংসার চলে না, কর দিলে খাব কি; এ ধরনের ওজর-আপত্তি আয়কর আইনে চলে না। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের ১৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে কতজনের আয়কর দেয়ার কথা। উল্লেখ্য, করমুক্ত আয়ের পরিমাণ বার্ষিক দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। দৈনিক হিসাবে হয় ছয় শ’ ৮৪ টাকা ৯৩ পয়সা। ধরা যাক ৭০০ টাকা। এই ভিত্তিতে সম্ভাব্য করদাতার সংখ্যা কত হওয়া উচিত? দশ লাখ, চল্লিশ লাখ, এক কোটি, দুই কোটি...?’ আমার কাছে কোন হিসাব নেই। তবে সরকারের লোকজন প্রায়শই বলেন, আমাদের আয়কর দাতার সংখ্যা অতি নগণ্য। বিদেশীরাও বলেন তাই। বলতেই পারেন। কারণ, ৭০০ টাকা দৈনিক রোজগার কার নয়? রিক্সাওয়ালা, কাঁচা দোকানদার, বাদামওয়ালা, পামওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, মৎস্য বিক্রেতা থেকে শুরু করে ছোট, মাঝারি ও বড় মুদিদোকানওয়ালা; সবারই দৈনিক রোজগার ৭০০ টাকার ওপরে। এটা দৃশ্যমান বাস্তবতা। কিন্তু, বলা বাহুল্য, এদের সিংহভাগই করজালের বাইরে। ধরা খাওয়া লোকজন হচ্ছে কতক চাকরিজীবী-সরকারী ও বেসরকারী। সরকারী চাকরিজীবীরা আগে কর দিত না। এখন তাদের দিতে হয়। বেসরকারী খাতের কোম্পানি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও করের আওতায় আনা হয়েছে। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরাও এখন করের আওতায়। এতসব করার পরেও কতজন মোট আয়করদাতা? টিআইএনধারী কতজন? কতজন প্রকৃতপক্ষে রিটার্ন জমা দেন? কাগজে এই সম্পর্কে নানা খবর দেখি। তবে নিয়মিত করদাতা মনে হচ্ছে, আসলে ১০-১২ লাখের বেশি হবে না। যদি তাই হয় তাহলে তো দেশের লাখ লাখ লোক ‘করফাঁকিবাজ’। আইন মোতাবেক তো তাই হওয়ার কথা। আর যারা কর দেন তাদের একটা বিরাট অংশ দেন নামমাত্র। একটি কাঁচাবাজারের মুদি দোকানদার যার দৈনিক বিক্রি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, তিনি বর্তমানে কর দেন না। দুই-তিন বছর আগে দিতেন মাত্র দুই হাজার টাকার মতো। তার নিজের মুখেরই কথা। এসব কারণেই জর্দা বিক্রেতারা সর্বশ্রেষ্ঠ করদাতা। তার মানে, যাদের অনেক বেশি কর দেয়ার কথা তারা দেন নামমাত্র। সর্বশ্রেষ্ঠ করদাতার খাতায় তাদের নাম নেই। গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানম-ির বাড়ির মালিকদের নাম ‘ওয়েলথ ট্যাক্সের’ (সম্পদ কর) খাতায় নেই। কর অর্থ কী? এর অর্থ যে সমস্ত চাকরিজীবী আয় লুকাতে পারেনি তারাই আয়করের শিকার। বাকিরা আরামে আছেন। এতে কি দেশে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে না? বৈষম্য করদাতা এবং করদাতা নন এমন লোকের মধ্যে। বৈষম্য প্রকৃত পরিমাণ করদাতা এবং নামমাত্র করদাতাদের মধ্যে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন লাখ লাখ লোক, কোটির অনেক ওপরের লোক দেশের আয়করের খাতায় নেই। যদি থাকত তাহলে বার্ষিক আয়কর থেকে কত আসত? ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের মোট রাজস্ব ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আয় আসবে ‘ভ্যাট’ থেকে। এর পরেই আয়করের স্থান। এর পরিমাণ মোট রাজস্বের ৩৪ দশমিক ৩ ভাগ। টাকার অঙ্কে হবে ৮৫ হাজার ১২৯ কোটি। ভাবা যায়! যদি করযোগ্য আয়ের মালিকরা সবাই হিসাবমতো কর দিতেন তাহলে রাজস্ব আয় হতো ৫, ৭, ১০ লাখ কোটি টাকা। আর কোন রাজস্বের দরকার ছিল না, এমনকি ভ্যাটেরও। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪৬-৪৭ বছর পরেও আমরা ১০-১২ লাখ লোকের বেশি লোক পেলাম না যারা কর দিচ্ছে। এটা বাস্তবতা, কঠিন বাস্তবতা। ফলে যারা বিদ্যমান করদাতা তাদের ওপরই চলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জুলুম। এমতাবস্থায় কী করা যায়? এমন ব্যবস্থা কী করা যায় যাতে বর্তমান ব্যক্তিকরদাতারা কর থেকে মুক্ত হন, আবার ‘কর ফাঁকিবাজ’ বলে পরিচিত লোকেরাও এই বদনাম থেকে বাঁচে? এমন ব্যবস্থার কথা কি ভাবা যায় যেখানে সকল মানুষই আয়করের ভীতি থেকে মুক্ত হয়। এমন ব্যবস্থার কথা কি ভাবা যায় যেখানে মানুষ আরও সঞ্চয় করতে পারে যা আমাদের উন্নয়নে কাজে লাগবে। করদাতা এবং করদাতা নয় অথচ করদাতা হওয়া উচিত এমন ব্যক্তিদের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে তার থেকে কি দেশকে মুক্ত করা যায়? অর্থাৎ ব্যক্তিগত আয়করের কি কোন বিকল্পের কথা ভাবা যায়? এই প্রশ্ন আরও জরুরী। কারণ আয়করদাতারা অন্যান্য উন্নত দেশের মতো সরকারের কাছ থেকে বৃদ্ধ বয়সে অথবা বিপদে চিকিৎসায় কোন সাহায্য পায় না। আরও কারণ হচ্ছে, এখন ‘ভ্যাট’ হচ্ছে সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা যা পরোক্ষ কর এবং ‘কনজামশন ট্যাস্ক’। আয়করের পাশাপাশি চালু এই ব্যবস্থা অনন্য। বর্তমান আয়কর ব্যবস্থা দেশে কর সম্পর্কে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তা না হলে কোটি কোটি লোক এর আওতায় আসতে চায় না কেন? এর সাক্ষ্য ৪৬-৪৭ বছরের অভিজ্ঞতা। এমতাবস্থায় একটা বিকল্প ব্যবস্থার কথা এখানে তুলে ধরা যায়। ব্যক্তিগত আয়কর ব্যবস্থা উঠে গেলে সরকারের ক্ষতি হবে বড়জোর ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা। একটিমাত্র ব্যবস্থা গৃহীত হলে প্রায় পুরোটাই ‘কমপেনসেট’ করা যায়। আর সেটি হচ্ছে ‘বন্ডেড ওয়ারহাউজ’ সুবিধার অপব্যবহার বন্ধ করা। ২০১৭ সালের ১০ নবেম্বরের একটি দৈনিকে রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন, বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার ‘বন্ডেড সুবিধা’ ‘লুট’ করা হয়, ফাঁকি দেয়া হয়। এটা রাজস্ব বোর্ডের গবেষণা তথ্য সম্ভবত। আসি ‘ভ্যাটের’ কথায়। প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে ভ্যাট ফাঁকির খবর ছাপা হয়। এসব যোগ করলে হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ড এসব যোগ করে দেখতে পারে। সরকারী ব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ হবে কম করে হলেও ৮০-৯০ হাজার কোটি টাকা। হাইকোর্টে ‘স্পেশাল বেঞ্চ’ তৈরি করে এবং মানিলোন কোর্টে মামলা ত্বরিৎ নিষ্পত্তি করে এই টাকা আদায় করা যায় মুহূর্তের মধ্যে। সব টাকার মালিকই হবে সরকার। এবার আসি টাকা পাচার প্রসঙ্গে। লোকের মুখে মুখে চালু এই কথা যে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে রেখেছে বাংলাদেশীরা অবৈধভাবে। প্রায় সময়ই বিপোর্টও ছাপা হয়। নিয়মিতভাবে এই টাকা আদায় করা যাবে না। ভারত ও পাকিস্তানসহ অনেক দেশ তার উদাহরণ। একটা কাজ করুনÑ বিদেশে গচ্ছিত অবৈধ টাকা সব জাতীয়করণ করুন। জাতিসংঘকে জানান এই টাকা উদ্ধারে সহায়তা করতে। জাতিসংঘের এটা অন্যতম কাজ। অবৈধ টাকা উদ্ধারে জাতিসংঘ কাজ করে। মার্কোসের টাকা, লিবিয়া ও মিশরের অবৈধ টাকা তারা উদ্ধার করে দিয়েছে। সরকার এই পথ ধরতে পারে। এই উৎস থেকে আসবে লাখ লাখ কোটি টাকা। সরকারী সম্পত্তি, জমি, উন্নত জমি বাজারমূল্যে বিক্রয় করুন টেন্ডারে। পূর্বাঞ্চলের জমি এভাবে বিক্রি করলে লাখ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে। রেলওয়েসহ সরকারী বিভিন্ন সংস্থার বেদখলি জমি ‘মার্শাল ল’ জারি করে উদ্ধার করে বাজার মূল্যে বিক্রি করুন। বিদেশী কোম্পানিগুলো তাদের কারখানার কাঁচামাল আনা-নেয়ার সময় ভীষণভাবে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং করে। এর নাম ‘ট্রান্সফার প্রাইসিং’। ভাল করে ধরুন। হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হবে। একটি রিপোর্টে দেখলাম বাংলাদেশে কাজ করে এমন বিদেশীরা বছরে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা তাদের দেশে নিয়ে যায়। আবার সমপরিমাণ টাকা ‘হুন্ডিতে’ যায়। এই ক্ষেত্রে কাজ করলেও বহু টাকা রাজস্ব আয় হবে। ফেসবুক, গুগল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান, উবার ইত্যাদিও কোন কর দেয় না বলে কাগজে দেখছি। এদের করের আওতায় আনা হোক। বিজ্ঞাপনের জন্য কর আদায় করা হোক। সবশেষে আরেকটি কথা বলা দরকার। সরকারের খরচের গুণগতমান খুব খারাপ। এক টাকার কাজ দুই টাকায়, তিন টাকায় হয়। এটা সবারই অভিযোগ। এই ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা অর্জন করে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ব্যয় বাঁচানো সম্ভব। এমন ধরনের অনেক পথ আছে, যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে এবং এর পরিণতিতে ব্যক্তিগত আয়কর দাতারা আয়কর থেকে মুক্ত হতে পারেন। আয়কর থেকে মুক্ত হতে পারেন সরকারী কর্মকর্তারা। এমনকি ‘এনবিআর’ কর্মকর্তারাও। এটা কোন অসম্ভব কল্পনা নয়। একটু গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলেই তা করা সম্ভব বলে মনে করি। আমি আসলে বলছি সঞ্চয় বৃদ্ধির কথা। মধ্যবিত্তই সঞ্চয় করে। সরকারী ও বেসরকারী চাকরিজীবীরা সঞ্চয় করে। এমনকি গরিব, নিম্নবিত্তরাও সঞ্চয় করে। এর কারণ আছে। আমরা আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপীয় কোন দেশ নই। ওদের সঞ্চয় না করলেও চলে। তারা ট্যাক্স দেয়, ভাল ট্যাক্স দেয়। এর বদলে সরকার তাদের দেখভাল করে। পরিবারের বিকল্প হয়েছে সরকার। ওদের পরিবার নেই। কিন্তু আমাদের পরিবার আছে। শুধু আত্মীয়স্বজন নয়, আমাদের গ্রামবাসীদেরও দেখাশোনা করতে হয়। তাদের সুখ-দুঃখ দেখতে হয়। গরিব আত্মীয়স্বজনের অভাব চাহিদা দেখতে হয়। এসব সরকার করে না। যেহেতু করে না, তাই আমাদের মধ্যবিত্তকে সঞ্চয় করতে হয়। এই সঞ্চয় থেকেই ওরা বিপদে-আপদে রেহাই পায়। আমি তাদের কথাই বলছি। ওরা কারও কাছে হাত পাতে না। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ওরা নেই। অতএব এদেরকে করের ভার থেকে মুক্ত করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা সরকার এখন উৎসেই সব কর কেটে নেয়। আয়করের প্রায় ৯০ শতাংশই উৎসে কেটে নেয়া হয়। তারপর আবার রিটার্নের প্রয়োজনীয়তাই বা কী? সরকার এগোচ্ছে ‘ভ্যাট’ নিয়ে। ভ্যাট পরোক্ষ কর। যদি ভ্যাটই আমাদের নিয়তি হয় তাহলে আয়কর কেন? কনজামশন ট্যাক্স (এক্সপেন্ডিচার ট্যাক্স) এবং ইনকাম ট্যাক্স দুটোই স্ববিরোধিতাপূর্ণ নয় কী? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×