ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

আবার স্টেজ মাতাল বামবা

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ১০ মে ২০১৮

আবার স্টেজ মাতাল বামবা

সময়টা ১৯৮৭ সাল, চারদিকে বন্যার্ত মানুষের হাহাকার। তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ এ্যামেচার মিউজিক্যাল ব্যান্ডস এ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে বামবা। বন্যার্তদের সাহায্যের উদ্দেশে কনসার্টের আয়োজন করে বামবা। আশির দশকে আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানের পাশাপাশি ব্যান্ডসঙ্গীত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। বাড়ছিল ব্যান্ডের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিল্পী দেশের সক্রিয় ব্যান্ডগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ এ্যামেচার মিউজিক্যাল ব্যান্ডস এ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা। এর পরের বছর প্রথম পাবলিক কনসার্ট করে। বামবা গঠনের, অর্থাৎ ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সময়ের যাত্রা পথের কার্যক্রমই বামবাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৯৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে ‘ফ্লাড এইড, ’৮৭’ শিরোনামের কনসার্ট আয়োজন। অনুষ্ঠান থেকে অর্জিত অর্থ বামবার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির ত্রাণ তহবিলে দান করা হয়। ১৯৮৭ সালের ফ্লাড এইড কনসার্ট দিয়ে যে বামবার শুরু, পরবর্তী সময়ে তা একটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। পরের বছর ১৯৮৮ সালে প্রথম পাবলিক কনসার্ট করে বামবা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ওই কনসার্ট ছিল দুর্ঘটনায় একজন আহত ব্যক্তির চিকিৎসা সহায়তায়। পরের বছর একই স্থানে বন্যার্তদের জন্য কনসার্ট করে রাষ্ট্রপতির ত্রাণ তহবিলে ৩ লাখের বেশি টাকা হস্তান্তর করা হয়। ১৯৯০ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন একজন ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা-সহায়তায় কনসার্ট করে বামবা। স্বৈরশাসক এরশাদ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস উপলক্ষে সব ব্যান্ড নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে আয়োজন করা হয় ওপেন এয়ার কনসার্ট। মাত্র তিন দিন সময় হাতে নিয়ে এই আয়োজনটি করা হয়। ৫০ হাজার দর্শক শ্রোতার উপস্থিতি ওই সময়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৯২ সালে সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে টিকিটের বিনিময়ে একটি সফল কনসার্ট করে সাড়া ফেলে দেয় বামবা। সেবার মাত্র তিন দিনে ২০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছিল। বামবা প্রমাণ করে, টিকিট বিক্রি করেও মাঠভর্তি দর্শক- শ্রোতার সমাগম করা যায়। ঠিক ওই সময়ে বামবার নিজস্ব উদ্যোগে আয়োজন করা হয় বেশ কয়েকটি বড় রকমের কনসার্ট। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ ও ১৪ এপ্রিলের পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনসার্ট, ঘূর্ণিদুর্গতদের সাহায্যার্থে আয়োজিত বামবা কনসার্ট। এর ফলে সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সংগঠনটির অবদান বিভিন্ন মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে তারা কনসার্টের আয়োজন করেছে। মাঝে কয়েক বছর বিরতির পর গত বৃহস্পতিবার হয়ে গেল বামবা কনসার্ট। ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার হল ৪ এ অনুষ্ঠিত হয় ‘বামবা লাইভ চ্যাপ্টার ওয়ান’ কনসার্টটি। বামবার এখন মোট ব্যান্ড ২৭টি। গত দিন ‘লাইভ চ্যাপ্টার ওয়ানে’ ছিল ১১টি ব্যান্ড। চ্যাপ্টার টু কনসার্টটি হবে চট্টগ্রামে। সেখানে থাকবে বাকি ব্যান্ডগুলো। ১১টি পারফর্মিং ব্যান্ড ছাড়াও কনসার্টে উপস্থিত ছিলেন ২৭টি ব্যান্ডের প্রায় সব সদস্যরাই। ব্যান্ড শূন্য শুরুটা করে ‘শত আশা’ গানটি দিয়ে। এরপর ‘চলো আজ হারিয়ে যাই গোধূলির ওপারে’ ও ‘শোনো মহাজন’সহ বেশ কয়েকটি গান পরিবেশনা করে দর্শকদের মাতিয়ে তোলেন ব্যান্ডের গায়ক এমিল। এরপর একে একে মঞ্চে এসে দর্শকদের মন জয় করে মাইলস, ওয়ারফেইজ, ফিডব্যাক, অর্থহীন, দলছুট, ম্যাক ও ঢাকা, পেন্টাগন, নেমেসিস, আর্বোভাইরাস ও ভাইকিংসের পরিবেশনা। বামবা এই আয়োজন দিয়েই তারা সিরিজ কনসার্টের পরিকল্পনা নিয়েছে। পর্যায়ক্রমে বছরজুড়ে এগুলো করবে তারা। ‘বামবা লাইভ চ্যাপ্টার’-এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ‘স্কাই ট্র্যাকার’ জানায়, প্রতি বছর তিনটি করে এমন কনসার্ট হবে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০১৪ সালে বামবা তিন দিনের রক উৎসব করে। এরপর তারা ‘বামবা লাইভ চ্যাপ্টার-১’-এর মাধ্যমেই মঞ্চে ফিরল। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও কনসার্টের আয়োজন নিয়ে বাবমার সভাপতি হামিন আহমেদ বলেন, বামবার কার্যক্রম শুধু কনসার্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এতদিন আমরা মেধাস্বত্ব আইন প্রণয়ন ও পাইরেসি বন্ধে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত কনসার্টের পাশাপাশি বামবা নানা ধরনের আয়োজনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তাসহ নানা কারণে পরে বড় কোনো কনসার্টের সুযোগ হয়নি। শুধু বিরতি ভাঙতে নয়, ‘বামবা লাইভ-চ্যাপ্টার ওয়ান’ কনাসার্টের পেছনেও আরও একটি কারণ আছে। তাহলো দেশি ব্যান্ডসঙ্গীতের প্রসারে কাজ করা। তাছাড়া ‘দেশে অনেক জনপ্রিয় ব্যান্ড আছে। দর্শকদের নানা রকম পছন্দের কারণে ব্যান্ডগুলোর পরিবেশনাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁরা একই সঙ্গে একাধিক ব্যান্ডের পারফরম্যান্স পছন্দ করেন। সেই সংগীতপ্রেমীদের জন্য এই আয়োজন। যারা একসঙ্গে দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর পারফরম্যান্স উপভোগ করতে পারলেন। বর্তমানে ব্যান্ডসংগীত এতটা জনপ্রিয়তায় উঠে আসার পেছনে বামবার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে ব্যান্ডসঙ্গীতের উত্থান। তারুণ্যনির্ভর সঙ্গীতচর্চায় আনে সম্ভাবনা, তারুণ্যের বিনোদনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। তবে এই উত্থান কিছুদিন পরই থিতিয়ে আসে বিভিন্ন সামাজিক কারণে। ছিল না পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতার অভাব। এমন অবস্থায় ১৯৮৭ সালে প্রবাসী রেবেকা হোসেন ও মাইলস ব্যান্ডের হামিন আহমেদ মিলে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে একটি সফল কনসার্ট করেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বলরুমে ফিডব্যাক, সোলস, রেনেসাঁ, মাইলসসহ ১০টি ব্যান্ডের অংশগ্রহণে কনসার্টটি সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ওই কনসার্টের সফলতাই বামবার বীজ বপন করে।
×